খুলনায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ১৬ বছরের এক কিশোরকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। উত্তেজিত জনতা গতকাল বুধবার রাতে উপপুলিশ কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে ঢুকে তাকে পিটুনি দেয়।
পুলিশ জানায়, ওই কিশোর খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার বাসা খুলনা নগরের সদর থানা এলাকায়।
পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার মহানবী (সা.)-কে নিয়ে ওই কিশোর ফেসবুকে কটূক্তি করে বলে অভিযোগ। পরের দিন বুধবার দুপুরে ওই কিশোর নগরের টুটপাড়া এলাকায় কোচিং সেন্টারে গেলে তার বন্ধুরা তাকে আটকায়। কেন সে এমন কথা বলেছে, তা জানতে চায়। খবর পেয়ে ওই কিশোরের বাবা কোচিং সেন্টারে যান। তিনি ছেলে ও অন্যদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে তাদের পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিকেলের দিকে কিশোরের বাবা ও কয়েকজন শিক্ষার্থী উপপুলিশ কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে যান। ঘটনাটি জানাজানি হলে উত্তেজিত জনতা ওই কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা সেখানে যান। তাঁরা আইনের মাধ্যমে অভিযুক্তের বিচারের আশ্বাস দেন। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তা শোনেনি। রাত ১১টার দিকে বিক্ষোভকারীরা গেট ভেঙে কমিশনারের কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর করে, ওই কিশোরকে পিটুনি দেয়। পুলিশ একপর্যায়ে জনতাকে কার্যালয় থেকে বের করে দেয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ওই কিশোরকে পুলিশ কর্মকর্তার কার্যালয়ের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীর গাড়ি আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে।
ঘটনার বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি করায় স্থানীয় লোকজন ওই ব্যক্তিকে উপপুলিশ কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার স্থানীয় লোকজন উপস্থিত হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ওই কিশোরকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার জন্য আন্দোলন করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এ সময় কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা পুলিশের কার্যালয়ে ঢুকে ওই ব্যক্তির ওপর হামলা চালায়। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আপ্রাণ চেষ্টায় ওই কিশোরকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে সে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন। সে আশঙ্কামুক্ত।
আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেওয়ার কারণে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মামলা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তার সুস্থতা সাপেক্ষে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। ওই ব্যক্তির মৃত্যুসংক্রান্ত গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
খুলনার উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. তাজুল ইসলাম গতকাল গভীর রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, ওই কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে আদালতের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বিক্ষোভকারীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। উত্তেজিত জনতা কিশোরকে পিটুনি দেয়। তখন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কিশোর মারা গেছে। তবে আজ বৃহস্পতিবার সকালে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গণপিটুনির ঘটনার পর কিশোরকে সেনাসদস্যরা নিয়ে যান। এ ঘটনার সর্বশেষ তথ্য পুলিশ জানে না।
উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়টি খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা আবাসিক (দ্বিতীয় পর্যায়) এলাকায় অবস্থিত। এটি খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায়। ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু ছেলেটির বাড়ি সদর থানা এলাকায়, এ কারণে ওই থানাতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা হবে। এ ব্যাপারে ওই থানার লোকজনই ভালো বলতে পারবেন। আর উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনায় একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করবে।’
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন খান বলেন, ‘ধর্ম অবমাননা বা ওই সংক্রান্ত কোনো ইস্যু নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সদর থানা এলাকায় ওই কিশোরের বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায়। ওই বাসার মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরের বাবা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। প্রায় ১০ বছর ধরে পরিবারটি ওই বাসায় ভাড়া থাকছে। ওই কিশোরকে এর আগে কখনো এমন আচরণ করতে দেখেননি তিনি। বাসায় ওই পরিবারের কেউ নেই। তাদের মুঠোফোনও বন্ধ আছে। এ কারণে তিনি তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না।
সংশোধনী: পুলিশ গতকাল বুধবার রাতে জানিয়েছিল, গণপিটুনিতে ১৬ বছরের কিশোর নিহত হয়েছে। পরে আজ বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ জানায়, গণপিটুনির ঘটনার পর ওই কিশোরকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ ঘটনার সর্বশেষ তথ্য জানে না। পরে যোগাযোগ করলে আইএসপিআর জানায়, ওই কিশোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হয়।