যমুনা নদীর ওপর রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ দেশের উত্তরাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা এবার পূরণের অপেক্ষায়। বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্পের আওতায় যমুনার বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন সেতুটি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচল করছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রেলওয়ে সেতু চালু হওয়ার কথা আছে।
এই রেলওয়ে সেতু চালু হলে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দেশের যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। সেই সঙ্গে দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় আরও একটি মাইলফলক অর্জিত হবে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুটির প্রকল্প প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম বলেন, সেতুটির ওপর রেললাইন স্থাপন শেষ হয়েছে। প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। সেতুটির ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, সেতুটি খুলে দেওয়া হলে আমদানি-রপ্তানির খরচ কমে যাবে। বঙ্গবন্ধু সেতু ও মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমবে। মানুষের সহজ যাতায়াত যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনই উত্তরের জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা সহজ হবে, কমবে পণ্য পরিবহনের খরচ, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান বলেন, এই সেতুর সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে সময় সাশ্রয়। যমুনা নদীর ওপর বর্তমান সেতুটি বিপজ্জনক হওয়ায় একটি ট্রেন পার হতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় নেয়। যদি এই সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলে, তাহলে মাত্র ৫ মিনিটে যমুনা পার হওয়া যাবে।
রেলওয়ে–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও আয়বৈষম্য নিরসনে ভারসাম্যমূলক সমৃদ্ধির মূলে যোগাযোগব্যবস্থার ভূমিকা। আর যোগাযোগের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো রেলওয়ে।বাংলাদেশে তিন হাজারের বেশি রেলওয়ে সেতু আছে। এত দিন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে সেতু ছিল পাবনার পাকশীতে নির্মিত শত বছরের পুরোনো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। যমুনার ওপর নির্মিত রেলওয়ে সেতুটি খুলে দেওয়া হলে এটিই হবে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে সেতু।
রেলওয়ে সেতুটির প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ৯ হাজার ৭৩৪ দশমিক ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ দশমিক ৯৬ কোটি টাকায়। যার ১২ হাজার ১৪৯ দশমিক ২ কোটি টাকা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ হিসেবে দিয়েছে। প্রকল্পের নির্ধারিত সময় ছিল জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩। পরে এই সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সেতুটি উদ্বোধন হলে ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে। ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের রেলওয়ে যোগাযোগে বর্তমান যে বিড়ম্বনা আছে, সেটা আর থাকবে না। সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৮৮টি যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। কমে যাবে পরিবহনের খরচও। সেই সঙ্গে মহাসড়কের ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতিসীমা। বর্তমানে এই সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই রেলওয়ে সেতুই হবে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মেলবন্ধন। রেলসেতুটি দিয়ে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি চলাচল করতে পারবে। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে সড়কপথের পাশাপাশি রেলপথেও পণ্য পরিবহন সহজতর হবে এবং খরচও সাশ্রয় হবে। উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনবে।