শাশুড়ি ও স্বামীকে ফাঁসাতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যান দুমকির হালিমা: পুলিশ

হালিমা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

পটুয়াখালীর দুমকিতে হাত-পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে গৃহবধূ হালিমা আক্তার মারা যাওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে নতুন তথ্য পেয়েছে পুলিশ। পারিবারিক কলহে অতিষ্ঠ হয়ে শাশুড়ি ও স্বামীকে ফাঁসাতে গিয়ে ভাড়া বাসায় অগ্নিদুর্ঘটনায় হালিমা মারা যান ও তাঁর ছেলে গুরুতর দগ্ধ হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হালিমার চাচাতো ভগ্নিপতি আরিফ হোসেন সিকদার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় পটুয়াখালী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে প্রেস ব্রিফিং করে এ তথ্য দিয়েছেন পুলিশ সুপার মো. সাইদুল ইসলাম। বিয়ের পর থেকে হালিমার সঙ্গে শাশুড়ির দ্বন্দ্বের জেরে শাশুড়ি ও স্বামীকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে ভাড়া বাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন আরিফ।

পটুয়াখালীর দুমকিতে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ায় এক গৃহবধূ মারা যাওয়ার ঘটনার হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আজ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়

গৃহবধূ হালিমা আক্তারের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার আরিফের বাড়ি দুমকি উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের লেবুখালী গ্রামে। আরিফ ঢাকার কেরানীগঞ্জে কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মো. সাইদুল ইসলাম জানান, ৮ জুন বেলা তিনটায় দুমকির শাজাহান মুন্সির টিনশেড ভাড়া বাড়িতে হালিমা আক্তারকে (২০) হাত-পা বাঁধা অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন প্রতিবেশিরা। এ সময় তাঁর ছয় মাসের শিশুপুত্র জিসানও দগ্ধ হয়। ৯ জুন বিকেল পাঁচটায় ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে হালিমা মারা যান। তাঁর ছেলে জিসান সেখানে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় ওই দিনই নিহত হালিমার মামা মোহাম্মদ ওমর ফারুক দুমকি থানায় মামলা করেন।

পুলিশ সুপার ব্রিফিংয়ে আরও বলেন, হালিমা আক্তার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর এই ঘটনা তদন্তে নেমে পড়ে পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ ঘটনার সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে হালিমা অগ্নিদগ্ধের পর ৩টা ৩৩ মিনিটে কালো ক্যাপ, মুখে মাস্ক, আকাশি রঙের জামা, এবং কালো কেডস পরে এক যুবককে দৌড়ে ওই ভাড়া বাসার রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। এরপর ব্যাপক অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ এবং শতভাগ নিশ্চিত হয়ে ১১ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পটুয়াখালী নিয়ে আসা হয়।

গ্রেপ্তার আরিফ পুলিশের কাছে ওই দিনের পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, মে মাসের শেষ দিকে হালিমা আক্তার ও তাঁর শাশুড়ি পিয়ারা বেগমের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছালে হালিমা আসামি আরিফের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। এ সময় হালিমা আরিফকে বলেন, তাঁর স্বামী জামাল হোসেন আগের মতো নেই। তাঁর শাশুড়ি তাঁকে ও তাঁর ছেলে জিসানকে হত্যার চেষ্টা করলেও স্বামী তা বিশ্বাস না করে মায়ের কথা বিশ্বাস করে। এ কারণে হালিমা তাঁর স্বামী জামাল হোসেন ও শাশুড়ি পিয়ারা বেগমকে শিক্ষা দিতে তাঁরা তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারতে চাচ্ছেন–এমন একটি বিষয় প্রমাণ করার পরিকল্পনা করেন।

পুলিশ সুপার বলেন, হালিমা ও আরিফের পরিকল্পনা অনুসারে ৮ জুন সকালে হালিমা আক্তার আসামি আরিফ হোসেন সিকদারকে মুঠোফোনে পটুয়াখালী আসতে বলেন। তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আরিফ হোসেন বেলা আড়াইটার দিকে পটুয়াখালীর দুমকির পাগলা মোড়ে পৌঁছে মুঠোফোনে হালিমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিকানা অনুযায়ী বাসায় পৌঁছেন।

আরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ সুপার আরও বলেন, ঘরে যাওয়ার পর হালিমা নিজেই নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন; এরপর তাঁর ছেলে জিসানকে সামনের রুমে রেখে আসেন। ফিরে এসে নিজেই নিজের পা ও মুখ বাঁধেন এবং আরিফ তাঁদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পেছন দিয়ে হালিমার হাত বেঁধে বিছানার পাশে এক কোনে মশারিতে আগুন দিয়ে চলে যান। কিন্তু আগুন লাগানোর একপর্যায়ে কেরোসিনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে নিয়ন্ত্রণহীন আগুন হালিমা আক্তারের গায়ে লেগে যাবে, এটা তাঁরা বুঝতে পারেননি। এদিকে ঘটনার পরই আরিফ আবার ঢাকায় চলে যান এবং ঢাকা থেকে দগ্ধ হালিমার খোঁজখবর নেন। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পরও শাশুড়ি ও স্বামীকে শায়েস্তা করতে পরিকল্পনা অনুযায়ী বোরকা পরা ব্যক্তিরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে হালিমা উদ্ধারকারী ব্যক্তিদের জানিয়েছিলেন।

পুলিশ সুপার মো. সাইদুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় আরিফ হোসেনের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হালিমা ও আরিফ—দুজনের পরিকল্পনায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে আরিফ হোসেন গতকাল সোমবার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারপরও আমরা তদন্ত করে দেখছি এর পেছনে আরও কেউ সহযোগিতা করেছে কি না। বুদ্ধিদাতা ও পরিকল্পনার সঙ্গে কেউ যুক্ত ছিল কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’

২ জুন হালিমা ও জামাল দম্পতি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা শহরে নতুন বাজার এলাকায় শাজাহান মুন্সির বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ওঠেন। ৮ জুন বেলা তিনটার দিকে হঠাৎ হালিমা আক্তারের চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন এবং ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি বন্ধ পান। পরে তাঁরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শাড়ি ও ওড়না দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হালিমা আক্তারকে উদ্ধার করেন। এ সময় তাঁর শিশুপুত্রের হাতসহ বিভিন্ন স্থান আগুনে ঝলসানো ছিল।

প্রতিবেশীরা দুজনকে দ্রুত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। পরে রাতেই তাঁদের ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। ৯ জুন হালিমা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দগ্ধ শিশুসন্তান জিসান সংকটাপন্ন অবস্থায় সেখানে এখনো চিকিৎসাধীন।