রাজ্যমনি হাজং (৫৫) মানুষের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবন চালান। আকস্মিক বন্যায় তাঁর একমাত্র ঘরটি ভেঙে গেছে। এক কাপড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভাইয়ের ঘরে। গতকাল রোববার রাতে ঘরে থেকে বন্যার পানি সরেছে। আজ সোমবার সকাল থেকে ভাঙা ঘর নিয়ে করছেন দুশ্চিন্তা। ভাঙা ঘর মেরামত কীভাবে করবেন, সে সামর্থ্য নেই। তাই রাজ্যমনির জীবনে নেমেছে যেন রাজ্যের অন্ধকার।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের কমলপুর গ্রামে রাজ্যমনি হাজংয়ের বাড়ি। এ গ্রাম থেকে ভারতের সীমান্ত দুই কিলোমিটার দূরে। চারুয়াপাড়া বাজারের কাছে ৯ ঘর হাজং সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাঁদের একজন রাজ্যমনি হাজং।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে পানির তোড়ে রাজ্যমনি হাজংয়ের ঘরটি ভেঙে গেছে। তাঁর স্বামী উপেন্দ্র হাজং মারা গেছেন তিন বছর আগে। একমাত্র মেয়ে জনতা হাজংয়ের বিয়ে হয়েছে। বাবা যাত্রা মোহন হাজংয়ের বাড়ির পাশে পৌনে চার শতক জমি কিনে বসতঘর তুলেছিলেন। মাটির দেয়ালে টিনের ছাউনির ঘরটিই ছিল সম্বল। সেই ঘরটি বন্যায় ভেঙে গেছে।
আজ বেলা পৌনে একটার দিকে রাজ্যমনির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ঘরের টিন নুয়ে পড়েছে। পাশের বাড়ির পূজামণ্ডপে চলছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি। হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়িঘর পরিষ্কার করছিলেন। আলাপকালে রাজ্যমনি হাজং বলেন, শুক্রবার মধ্যরাতে হঠাৎই পানি আসে। কোনো জিনিসপত্র সরাতে পারেননি। এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছেন। মাটির দালান থাকায় ভয় ছিল। যদি শরীরের ওপর পড়ে। জীবন নিয়ে ভাইয়ের ঘরে আশ্রয় নেন। ভাঙা ঘর কীভাবে মেরামত করবেন, এই চিন্তায় আছেন। এখন বাজার খরচ করারই টাকা নেই, ঘর মেরামত করবেন কীভাবে?
রাজ্যমনির ছোট ভাই ভুতিষ চন্দ্র হাজং জানান, এমন বন্যা তাঁদের গ্রামে আগে কখনো হয়নি। শুক্রবার থেকে পানিবন্দী থাকতে হয়েছে। গতকাল রাতে পানি নামায় আজ একটু স্বস্তির মধ্যে আছেন। তবে বাড়ির চারদিকে পানি। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গামারীতলা ইউনিয়নের কলসিন্দুর গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম (৫০)। তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে গাজীপুরে তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। বাড়িতে একা থাকতেন রবিউল। গত শনিবার রাতে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন। পানির শব্দে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। মুহূর্তেই তাঁর দুটি ঘরের নিচের অংশ ভেঙে জিনিসপত্র ভেসে চলে যায়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত তাঁর বাড়িতে গিয়ে আজ দুপুরে আলাপকালে রবিউল ইসলাম বলেন, তাঁর ১০ বছরের সংসার ছিল ১৬ শতকের এই ভিটেমাটিতে। এখন সব শেষ। ঘর মেরামতের জন্য জমি বিক্রি করতে হবে। জমি বিক্রির জন্য ক্রেতাও নেই। আপাতত ভাইয়ের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন।
কলসিন্দুর নেতাই নদের ঘাটপাড় মসজিদ থেকে মালামাল সরাচ্ছিলেন আবুল কাশেম। ১৭ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে গত কোরবানির ঈদের সময় বাড়ি আসেন। বন্যার কারণে শুক্রবার মসজিদটিতে আবুল কাশেমের পরিবারসহ ছয়টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। শুক্রবার রাতে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উত্তর কলসিন্দুর গ্রামের আবুল কাশেম বলেন, তাঁর সাজানো সংসার সব শেষ। গত রাতে পানি সরে গিয়ে বাড়ি ভেসেছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে তিন হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছেন। আট সদস্যের পরিবার নিয়ে সেখানে কিছুদিন থাকবেন।
ভারতের মেঘালয় থেকে পাহাড়ি ঢল, টানা বৃষ্টি ও নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে শুক্রবার দুপুরের পর থেকে বন্যা দেখা দেয় ধোবাউড়া উপজেলায়। আজ গোয়াতলা ও ধোবাউড়া সদর এলাকায় পানি বাড়ছে। তবে দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারীতলা ও ঘোষগাঁও ইউনিয়নে পানি কমতে শুরু করেছে। পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নে পানি স্থিতিশীল। পানি কমতে থাকা দক্ষিণ মাইজপাড়া ও গামারীতলা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে।