সরকারের ‘সুনজরে’ থাকা শমসের মুবিন কেন জিততে পারলেন না

শমসের মুবিন চৌধুরী
শমসের মুবিন চৌধুরী

সরকারের ‘সুনজর’ আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা অংশের সমর্থন পেয়েও জিততে পারেননি ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী। সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তৃতীয় হন। এখানে বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।

গত রোববার ভোট গণনা শেষে সিলেট জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আসনটিতে ৫৭ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ও কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৪৮৮ ভোট। আর শমসের মুবিন চৌধুরী পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৩৬ ভোট।
আসনটির ৪ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৯ ভোটের বিপরীতে নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৭০২টি। এটি মোট ভোটের ২৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন ৫ হাজার ৫৭৯ ভোট, ইসলামী ঐক্যজোটের সাদিকুর রহমান ৬২২ ভোট এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আতাউর রহমান ১৬৯ ভোট পেয়েছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগেই ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান হয়ে আলোচনায় আসেন শমসের মুবিন চৌধুরী। এরপর তিনি সিলেট-৬ আসনে নির্বাচনে অংশ নিলে ‘ওপরের’ নির্দেশে শমসের মুবিন চৌধুরীকে জেতাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা অংশ প্রকাশ্যে সরব ছিলেন। এ অবস্থায় অনেকের ধারণা ছিল, শমসের মুবিনকে ‘জিতিয়ে নেওয়া’ হবে।

গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা শমসের মুবিন চৌধুরী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্পধারার মনোনয়নে সিলেট-৬ আসনে তিনি প্রার্থী হন। তবে নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরীসহ সিলেট-৬ আসনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দলের উচ্চপর্যায় থেকে শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অনেকেই প্রকাশ্যে প্রচারণায় নামেন। সবাই ভেবেছিলেন, শমসের মুবিনকে যেকোনো মূল্যে ‘জিতিয়ে আনা’ হবে। তবে শেষ পর্যন্ত এমন কিছুই ঘটেনি। আওয়ামী লীগের লোকজন শমসেরের পক্ষে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেন তিনি এত কম ভোট পেলেন, এ নিয়ে এখন নির্বাচনী এলাকায় জোর আলোচনা চলছে।

এত তোড়জোড়ের পরও পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, শমসের মুবিন চৌধুরী মূলত তিনটি কারণে হেরেছেন এবং কম ভোট পেয়েছেন। প্রথমত, তিনি সিলেট-৬ আসনে দীর্ঘদিন জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রকাশ্যে তাঁর জন্য কাজ করলেও দলটির অনেক কর্মী-সমর্থক তাঁকে ভোট দেননি। তৃতীয়ত, বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের বিরোধী পক্ষের ভোটের সিংহ ভাগই স্বতন্ত্র প্রার্থী সরওয়ার পেয়েছেন। এসব ভোট শমসের টানতে পারেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শমসের মূলত বিএনপির নেতা ছিলেন। পরে তিনি বিকল্পধারায় যোগ দেন। এখন তৃণমূল বিএনপিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এই দলবদলের বিষয়টি অনেক ভোটার ভালোভাবে নেয়নি। এ ছাড়া অনেক দিন ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা অংশ বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের বিরোধী হিসেবে আছে। এ অংশের ভোট সরওয়ার পেয়েছেন, শমসের পাননি। মূলত এসব কারণেই শমসের কম ভোট পেয়েছেন।’

ফলাফল নিয়ে শমসের মুবিন চৌধুরীর মূল্যায়ন জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। এমনকি শমসেরের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেতৃত্ব দেওয়া গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরীর মুঠোফোনে কল করলে তিনিও সাড়া দেননি।

সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। যোগাযোগ করলে এবারের নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ আমাকে ভালোবাসেন, এবারের ভোটে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হলো। ভোটাররা সমর্থন দিয়েছেন বলেই নানা ষড়যন্ত্রের পরও বিজয় এসেছে। এর বাইরে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।’