মা ইলিশ রক্ষায় ৩ অক্টোবর থেকে সাগরে মাছ ধরায় ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এ কারণে কক্সবাজারের হাটবাজারে সামুদ্রিক মাছের তীব্র সংকট চলছে। এর ফলে শুঁটকির চাহিদা বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। তবে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লিতে কমেছে শুঁটকির উৎপাদন। এ জন্য বাড়ছে শুঁটকির দামও।
পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম ‘নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লি’। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে মহাল আছে প্রায় ৭০০টি। জেলার টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, সোনাদিয়া দ্বীপেও শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলার ৮ শতাধিক মহালে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ১৪০ মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি।
তবে মৎস্য বিভাগ ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৩ অক্টোবর থেকে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় শুঁটকির উৎপাদন কমে এসেছে। এখন কয়েক শ মহালে দৈনিক ২০-৩০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিনে উৎপাদন আরও কমতে পারে। এ কারণে হাটবাজারে শুঁটকির দাম বাড়ছে।
গত শনিবার সন্ধ্যায় শহরের কানাইয়ার বাজার, বড়বাজার, বাহারছড়া বাজার, সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী এলাকার শতাধিক দোকান ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকসহ স্থানীয় বাসিন্দারা শুঁটকি কিনছেন।
সুগন্ধা পয়েন্টের একটি দোকান থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় দেড় কেজি চাপা শুঁটকি কিনেছেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা গিয়াসুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি শুঁটকির দাম পড়েছে এক হাজার টাকার বেশি। যদিও ৭ দিন আগে এই শুঁটকি ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
অতিরিক্ত দামে শুঁটকি বিক্রির কারণ জানতে চাইলে দোকানের কর্মচারী আবদুল আজিজ বলেন, বাজারে শুঁটকি নেই। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে বেশি দামে শুঁটকি কিনে এনে পর্যটকের চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। এ কারণে দামও বেশি।
শহরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি লাক্ষা শুঁটকি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, কোরাল ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়, সুরমা ৭০০-৮০০ টাকা, টুনা ৬০০-১ হাজার ৪৫০ টাকা, রুপচাঁদা ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শহরের কানাইয়ার বাজারের ‘হাবিব শুঁটকি এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি দোকানের মালিক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ক্রেতাদের ৮০ শতাংশই স্থানীয়। বাজারে এখন সামুদ্রিক মাছ নেই। এ কারণে শুঁটকির চাহিদা বেড়েছে অনেক। অবশ্য শুঁটকির উৎপাদনও অনেক কমেছে। তাই চড়া মূল্যে দোকানের শুঁটকি বেচাবিক্রি করতে হচ্ছে। সাত দিন আগেও প্রতি কেজি লইট্যা শুঁটকি বিক্রি হয়েছে ৫০০-৫৫০ টাকায়। এখন ৮০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
হঠাৎ শুঁটকির চাহিদা বাড়ায় আমদানি করা নিম্নমানের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান কক্সবাজার শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সদস্যরা। এই সমিতির সদস্যসংখ্যা ৩৫০। সমিতির সদস্যরা গত কয়েক মাসে ৯৩০ মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি উৎপাদন করেছেন।
সমিতির সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর থেকে বাজারে সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। সামুদ্রিক মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় শুঁটকির চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি উৎপাদনও কমেছে অনেক। এ সুযোগে সৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী এলাকার শতাধিক দোকানে ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে আনা নিম্নমানের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে। শুঁটকিগুলো দুই-তিন বছরের পুরোনো। ক্রেতারা যেন বুঝতে না পারেন, সে জন্য এসব শুঁটকি পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হয়।
শহরের অধিকাংশ শুঁটকির দোকানে লোনা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। ৪৫০-৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি লোনা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, স্থানীয় বাসিন্দাদের চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ লোনা ইলিশ বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামে সরবরাহ হচ্ছে।
দেশের সর্ববৃহৎ নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের শুঁটকি উৎপাদিত হয় জানিয়ে নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, চলতি মৌসুমে সমুদ্রে মাছ আহরণ অনেক কম হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা শেষে কাঙ্ক্ষিত মাছ ধরা না পড়লে শুঁটকি উৎপাদনে ধস নামতে পারে।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাস শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম ধরা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদিত হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল ৩১ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন।