দেশের চলমান পরিস্থিতিতে পরিবহনসংকটের পাশাপাশি চাহিদা কমে যাওয়ায় খামারে উৎপাদিত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পাবনা ও সিরাজগঞ্জের দুগ্ধ খামারিরা। দেশের অন্যতম গরুর দুধ উৎপাদনকারী এ এলাকার খামারিরা বলছেন, ৩৫ থেকে ৪০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৭০ টাকার কাছাকাছি।
এ ছাড়া পরিবহনসংকটের কারণে বাইরে থেকে খড়, ভুসিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আসতে না পারায় হঠাৎ করেই গোখাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে খামারিদের লোকসান আরও বেড়ে গেছে।
দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, তাড়াশ উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকার ২৫ হাজারের বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। ফলে বিভিন্ন কোম্পানিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এ এলাকা থেকে তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশের বাজারে ও সরবরাহ বিক্রি করে থাকে।
খামারিরা অভিযোগ করে বলেন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের দুধ বিক্রি করার প্রধান ভরসা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দুধের সঠিক দাম দেয় না। এর ওপর সর্বাত্মক অবরোধ (কমপ্লিট শাটডাউন), কারফিউসহ দেশের চলমান সহিংসতার অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনাও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে খামারিদের উৎপাদিত দুধের একটি বড় অংশ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এই দুধ খামারিরা খোলাবাজারে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তাঁরা আরও বলেন, গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৭০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দেয় ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। এখন এ দামেও দুধ বিক্রি করতে না পারায় খামারিদের লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে।
খামারিরা জানান, ১০ দিন আগে থেকে ঢাকা শহরে দুধের চাহিদা কমতে থাকে। এ ছাড়া এ এলাকার ছানা তৈরির শতাধিক কারখানা দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ছানা তৈরির কারখানাগুলো আগে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করত। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ছানা সরবরাহ করা হতো। কয়েক দিন ধরে দেশের মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ থাকায় এখন আর ছানার চাহিদা নেই। তাই বেশির ভাগ ছানা তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী মাসুদ শেখ জানান, স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে দুধ কিনে তিনি ঢাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে থাকেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার লিটার দুধ ঢাকায় পাঠাতেন। অথচ এক সপ্তাহ ধরে ২০০ থেকে ৩০০ লিটার দুধ পাঠাচ্ছেন।
তিনি বলেন, খামারিদের কাছ থেকে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি লিটার দুধ ৫০ থেকে ৫২ টাকায় কিনতেন। অথচ সর্বাত্মক অবরোধ (কমপ্লিট শাটডাউন) ও কারফিউর কারণে চাহিদা পড়ে যাওয়ায় তিনি এক সপ্তাহ ধরে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা লিটার দরে দুধ কিনেছেন। এরপরও অনেক খামারির দুধ তিনি কিনতে পারেননি। তবে গতকাল বুধবার যানবাহন চলাচল করায় দুধের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। এ কারণে দুধের দামও কিছুটা বেড়েছে। গতকাল তিনি খামারিদের কাছ থেকে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা লিটার দরে দুধ কিনেছেন।
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরে খামারিদের প্রায় দ্বিগুণ দামে গোখাদ্য কিনতে হচ্ছে। খামারিরা বলেন, সাত–আট দিন ধরে খড়ের দাম প্রতি মণে ১০০ টাকা বেড়েছে। এর আগে প্রতি মণের দাম ছিল ৪০০ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আর ভুসির প্রতি বস্তার (৩৭ কেজি) দাম ১ হাজার ৭০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৯০০ টাকা হয়েছে।
বেড়া উপজেলা ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজা খানম বলেন, ‘এমনিতেই খামারিরা দুধের ন্যায্য দাম পান না। এর ওপর প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় খামারিরা উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে ব্যাপক লোকসান দিয়ে বিক্রি করছেন। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। এ অবস্থায় আমরা (খামারিরা) আর পারছি না।’
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত মিল্ক ভিটার বাঘাবাড়ীঘাট দুগ্ধ এলাকার উপমহাব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘খামারিদের সব রকম দুঃসময়ে আমরা তাঁদের পাশেই থাকি। আমাদের কাছে আসা সব খামারির দুধই আমরা নিয়ে নিচ্ছি। আগের মতোই ভালো মানের দুধের দাম ৫২ টাকা লিটার দরে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন এই এলাকা থেকে আমরা এখন ৬৫ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছি।’
বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, এ এলাকার অনেকের সংসার চলে দুধ বিক্রি করে। নানা সমস্যায় তাঁরা আজ চরম বিপাকে আছেন। আশা করছেন, এ পরিস্থিতির শিগগিরই পরিবর্তন হবে।