‘গরমে দমডা বন্ধ হয় আসেচে, বোয়াল মাছের মতো মুখখান হাঁ করে দম নিবা নাগেছে। রোদখান আর সহা যায় না। শরীলডা (শরীর) ঘামে ভিজে যাছে। এ্যানোং গরম করিলে (এ রকম গরম পড়লে) কামকাজ করা যাবেনি। খুব কষ্ট হামার গরিব মাইসির। ’ রোববার দুপুরে খেত থেকে ভুট্টা সংগ্রহ করতে করতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর মানব চন্দ্র ঘোষ (৪২)।
মানব চন্দ্র ঘোষ পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়নের জুগিকাটা এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, একসঙ্গে আটজনের একটি দল কাজ করছে ভুট্টা ভাঙার (খেত থেকে তোলার)। মালিকের কাছে চুক্তি হিসেবে এসব কাজ করছেন তাঁরা। তবে রোদের তাপের ভয়ে খুব সকালবেলা কাজ শুরু করেছেন। বেলা দুইটার মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়িতে যাবেন। এ সময় পাশেই একটি মরিচখেতে মাথায় ছাতা নিয়ে পাকা মরিচ তুলছিলেন কৃষক সাদেকুল ইসলাম। তিনি বলেন, রোদের যে তাপ, মনে হচ্ছে আগুন পড়ছে। মাটিখান এত গরম হইচে পাওলা থুয়া (রাখা) যায় না। বেশি রোদ করিলে শরীলোত মরিচের ঝাঁজ লাগেছে। ’
গত কয়েক দিন তাপপ্রবাহের কারণে দিনমজুর মানব চন্দ্র ঘোষ ও কৃষক সাদেকুল ইসলামের মতো পঞ্চগড়ের শ্রমজীবী মানুষ বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যখন বৃষ্টিপাত আর জলোচ্ছ্বাসে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, ঠিক তখনই দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চলছে তাপপ্রবাহ।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার থেকে পঞ্চগড় জেলায় শুরু হয়েছে তীব্র রোদ। ওই দিন তেঁতুলিয়ায় ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পর আবারও শুরু হয় তীব্র তাপপ্রবাহ। সর্বশেষ রোববার তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলেসিয়াস। এর আগে গত শনিবার তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শুক্রবার তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপতাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ তাপতাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে এই এলাকায় প্রখর রোদ হলেও রোববার রাতে পঞ্চগড়ের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন তেঁতুলিয়ার আবহাওয়া কর্মকর্তারা।
রোববার পঞ্চগড় সদর ও আটোয়ারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে কৃষকেরা দল বেঁধে ভুট্টাখেত থেকে ভুট্টা তুলছেন। কয়েকজন কৃষক ছাতা মাথায় নিয়ে মরিচখেত থেকে পাকা মরিচ তুলছেন। কেউ কেউ আবার ফাঁকা মাঠে মরিচ শুকাচ্ছেন। খেত থেকে শ্রমিকদের কেউ কেউ তুলছেন মিষ্টিকুমড়া। ঘেমে ভিজে যাওয়া শ্রমিকদের কেউ কেউ আবার খেতের পাশের গাছের ছায়ায় বসে পানি পান করছেন।
আটোয়ারী উপজেলার জুগিকাটা এলাকায় সড়কের পাশে বাড়ির সামনে ঠান্ডা পানি দিয়ে গরুকে গোসল করাচ্ছেন রমজান আলী (৫০) নামের এক কৃষক। তিনি বলেন, ‘যে গরম হামরা মানুষলায় থাকিবা পারি না। আর পশুপাখিলা তো কষ্ট পাইলেও কহিবা (বলতে) পারে না। গরুডার গরমে অবস্থা খারাপ। এইতানে গাওখান ধুয়ায় দেছু।’
আছিয়া বেগম নামে একজন মরিচ তোলা শ্রমিক বলেন, ‘এইবারকার মতো কুনুবারে এত গরম হয়নি বাপু। রোদখানোত বেশি কামকাজ করা যায় না। আগের দিনোত সকালে কাজ শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত করিছি। আর এ্যাল দুপুরের পর আর থাকা যায় না। রোদখানোত মনডা কহচে দেহাডা (শরীরটা) পুড়া যাছে। ’
অতিরিক্ত গরমে সচেতনতার বিষয়ে পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত প্রচণ্ড রোদের সময় যতটুকু সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের রোদে বের না হওয়াই ভালো। তবে মাঠে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের শরীর ঘেমে গেলে যে আশপাশের শীতল স্থানে বসেন এবং শরীর কিছুটা শীতল হলে পানি পান করেন। এ ছাড়া বেশি দুর্বল মনে হলে খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। আর রোদ থেকে বাড়িতে ফিরে সরাসরি গোসল করা যাবে না। আগে বিশ্রাম নিয়ে শরীর ঠান্ডা করে তারপর গোসল করতে হবে।’