কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১) বড় আকারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা পৌনে ১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গার ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। আগুনে পুড়ে আট বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে সাত বছর বয়সী আরেক রোহিঙ্গা শিশু।
একটি রোহিঙ্গা বসতির রান্নাঘরের চুল্লি থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে জানা গেছে। বেলা আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও ৫০০ পরিবারের অন্তত ৩ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় হারিয়ে প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এই আশ্রয়শিবিরে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস।
ঘটনাটি নিশ্চিত করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বেলা পৌনে একটার দিকে আশ্রয়শিবিরের একটি রোহিঙ্গা বসতি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে অন্যান্য রোহিঙ্গা বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের স্বেচ্ছাসেবীরা তৎপরতা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে একজন রোহিঙ্গা শিশু নিহত এবং আরেকজন রোহিঙ্গা শিশু নিখোঁজ থাকার তথ্য পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার ঘর পুড়ে গেছে। গৃহহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরানোর কাজ চলছে।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতারা জানান, এর আগে গত ১ জুন দুপুরে উখিয়ার তানজিমারখোলা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৩) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৭৫টি রোহিঙ্গা বসতিসহ অন্তত ২৩০টি অবকাঠামো পুড়ে গিয়েছিল। তাতে অন্তত ১ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছিলনে।
রোহিঙ্গা নেতা কামাল উদ্দিন বলেন, আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের (সিআইসি) কার্যালয়ের পাশের একটি রোহিঙ্গা বসতির রান্নাঘরে আগুন জ্বলে ওঠে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উড়তে দেখে রোহিঙ্গারা ঘটনাস্থলে ছুটে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ছুটে আসা বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত আশপাশের বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ত্রিপল ও বাঁশের বেড়ার তৈরি ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো এবং আশ্রয়শিবির ঘনবসতির হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। এ সময় সেনাবাহিনী, এপিবিএনসহ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দেন। বেলা আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও ততক্ষণে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আগুন পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে রোহিঙ্গা সাব্বির আহমদের (৪৫) ঘর। স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাব্বির আহমদ পাহাড়ের পাশে খোলা মাঠে অবস্থান নিয়েছেন। সাব্বির আহমদ বলেন, কিছু বোঝার আগে তাঁর ঘরেও আগুন ধরে যায়। পরনের কাপড় নিয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খোলা মাঠে এসে দাঁড়ান। কাপড়চোপড়, মূল্যবান সম্পদ সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। প্রচণ্ড শীতে সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ হোসেন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তবে তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেলেও এর পেছনে নাশকতা আছে কি না, অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, এই আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) শক্ত অবস্থান রয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের বিরোধের জেরে গত তিন বছরে আশ্রয়শিবিরে অন্তত পাঁচবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের ২৪ মে আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়। রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, সেটি ছিল নাশকতার আগুন। আশ্রয়শিবিরে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক চোরাচালানকে ঘিরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। উল্টো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। গত দুই মাসে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে নতুন করে ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছেন বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে সরকারি সূত্র।