বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। আর এই বিরোধের সুযোগ নিতে তৎপর ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী। বিএনপি মাঠে না থাকায় এ সুযোগ আরও অবারিত হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
ইসলামী আন্দোলনের এ তৎপরতা মূলত প্রার্থী মনোনয়ন ঘিরে শুরু হয়েছিল। গত ১৮ এপ্রিল দলটি প্রার্থী ঘোষণা করার কথা জানিয়ে পরে ওই দিন দুপুরে তা আকস্মিক স্থগিত করে। দলের গণমাধ্যম শাখা থেকে বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়, ‘অনিবার্য কারণবশত বরিশাল সিটিতে হাতপাখার প্রার্থীর নাম ঈদের পর ঘোষণা করা হবে।’ প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে দলটির এমন সময়ক্ষেপণ এবং আকস্মিক তা স্থগিত করার ঘটনা ওই সময় নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
ইসলামী আন্দোলন সূত্র জানায়, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর মেয়র পদে মনোনয়নের জন্য দুজনের নাম আলোচনায় ছিল। তাঁদের একজন দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন এবং বরিশাল জেলার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্র ও যুববিষয়ক সম্পাদক মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের। তাদের মধ্যে আবুল খায়ের প্রয়াত চরমোনাই পীরের ছেলে। আবুল খায়ের চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান। মেয়র নির্বাচন সামনে রেখে তাঁকে দল থেকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁর আরেক ছোট ভাই সৈয়দ মুহাম্মাদ জিয়াউল করিমকে। তিনি বর্তমানে ওই ইউপির চেয়ারম্যান।
ইসলামী আন্দোলন সূত্র জানায়, মুফতি ফয়জুল করিম ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকা নিয়ে গঠিত) আসনে দলের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭ হাজারের বেশি ভোট পান। আগামী নির্বাচনেও তাঁর এ আসনে প্রার্থী হওয়ার কথা আছে। কিন্তু হঠাৎ করে দলটি এ দুজনকে ছাপিয়ে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চরমোনাই পীরের মেজ ভাই ও দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিমকে। প্রার্থী মনোনয়নে দলটির এ নাটকীয়তা রহস্যজনক মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা, এমনকি আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারাও।
তাঁরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ও তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহর মধ্যে বিরোধ কাজে লাগাতে ফয়জুল করিমকে এখানে হঠাৎ করে প্রার্থী করা হয়েছে। কোনো পক্ষের সবুজ সংকেত পেয়ে হয়তো দল আকস্মিক সিদ্ধান্ত বদল করে মুফতি ফয়জুল করিমের মতো দলের জ্যেষ্ঠ নেতাকে এখানে প্রার্থী করেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, নির্বাচন মূলত কৌশলী এক লড়াই। এ লড়াইতে প্রার্থী ও দলগুলো সুযোগ কাজে লাগাবে, এটা স্বাভাবিক। বরিশালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যে বিভেদ–দ্বন্দ্ব জট পাকাচ্ছে, তার সুযোগ ইসলামী আন্দোলন নিতে পারে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এর আগে ২০১৩ সালেও ক্ষমতাসীন দলের এ বিভেদের সুযোগ নিয়েছিল বিএনপি।
আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন, যিনি বরিশাল সদর আসনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন এবং ভবিষ্যতে করার প্রস্ততি আছে; তাঁকে হঠাৎ করে মেয়র পদে দলটি মনোনীত করায় সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে।
বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন কারও নাম উল্লেখ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে যে কোনো ঝানু খেলোয়াড় কলকাঠি নাড়ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। এর জেরে ইসলামী আন্দোলন তাঁদের অন্যতম শীর্ষ নেতাকে এখানে প্রার্থী করেছে।’ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এ সদস্য বলেন, বরিশালে এমন নজির আগেও আছে। ২০১৩ সালে দলের জনপ্রিয় প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। তিনি এমন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হেরে গিয়েছিলেন, যা নিয়ে বরিশালবাসী এখনো আক্ষেপ করে। তবে এবার নগরবাসী সচেতন এবং অনেক বেশি সজাগ।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ আজ মঙ্গলবার নগরে গণসংযোগ শুরু করেছেন। তাঁর সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম ছাড়া জেলা ও নগর কমিটির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।
এদিকে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম এখনো গণসংযোগে মাঠে নামেননি। তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। ৮ মে বরিশালে আসবেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আশরাফ আলী আকন অবশ্য এমন কোনো তৎপরতার কথা স্বীকার করেননি। তিনি আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে তাঁরা মতামত দিয়েছেন, মুফতি ফয়জুল করিমকে প্রার্থী করলে ভালো হবে। সে বিবেচনায় করেছি।’ এ দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেউ কি আছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, তাই সব দলের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয় এবং হবে, এটা স্বাভাবিক।’ এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভোটারদের আনুকূল্য এবং ক্ষমতাসীন দলের কোনো পক্ষের সুদৃষ্টি আপনাদের প্রতি থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনই বলার সময় আসেনি। আরও পরে বোঝা যাবে। আমরা মনে করি, আমাদের প্রার্থী দলমত–নির্বিশেষে সব পক্ষের ভোট পাবেন।’