দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন এক আসামি। চাঁদা না দেওয়ায় বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করার অভিযোগ করেছেন তিনি।
১৫ নভেম্বর বিকেলে পুলিশ ওই আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে দিনাজপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইব্রাহিম আলীর আদালতে পাঠালে তিনি বিচারকের কাছে লিখিত অভিযোগ করে ২০০ ধারায় জবানবন্দি দেন। আদালত অভিযোগের বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পুলিশ সুপার ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
ওই আসামির নাম জিয়াউর রহমান। তিনি সদর উপজেলার আস্করপুর ইউনিয়নের খানপুর গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি আস্করপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৬ সালের আগে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ২০২২ সাল থেকে রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় নন।
আসামির স্বজন, কারাগারের নথি ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ অক্টোবর বেলা ১১টায় দিনাজপুর শহরের গোর-এ-শহীদ বড় মাঠ থেকে জিয়াউর রহমানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম হত্যা মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১৪ নভেম্বর আদালতে শুনানি শেষে তিনি জামিন পান। পরদিন কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় ফটক থেকে আবার তাঁকে আটক করে থানায় আনে পুলিশ। এরপর কোতোয়ালি থানায় সম্প্রতি পুলিশ বাদী হয়ে করা একটি অস্ত্র মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে আদালতে পাঠায়। আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২০০ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ওসির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন জিয়াউর রহমান। জবানবন্দি রেকর্ডের পর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
জবানবন্দিতে জিয়াউর রহমান নিজেকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে জানান, বর্তমানে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। ২৭ অক্টোবর কোতোয়ালি থানার ওসি (মতিউর রহমান) তাঁকে চা খাওয়ার জন্য ডাকেন। পরে তিন লাখ টাকা দিলে হালকা ধারাযুক্ত মামলা দিয়ে চালান দেওয়ার কথা বলেন ওসি। জিয়াউর টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই জানালে কোনো কারণ ছাড়াই জিআর-৫৩০ হত্যা মামলায় তাঁকে চালান করে দেন ওসি। ১৪ নভেম্বর জিয়াউরের জামিন হয়। পরদিন জেলের মধ্যে (কারাফটক) থাকা অবস্থায় কোতোয়ালি থানার ছয়জন পুলিশ সদস্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসেন এবং অস্ত্র মামলায় চালান করে দেন। কিন্তু ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। জামিন পেয়ে বের হওয়ার সময় গেট থেকেই তাঁকে আবার আটক করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদা দাবির অভিযোগ সত্য নয়। আসামি জিয়াউর রহমান একজন অপরাধী। আটক করা হয়েছে বলে তিনি নানা কথা বলছেন। তাঁকে জেলের ভেতর থেকে আটক করা হয়নি। বিষয়টি পিবিআই তদন্ত করছে।
পিবিআইয়ের দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, একজন আসামি আদালতের কাছে একটি জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত সেটি আমলে নিয়ে তাঁদের তদন্তের দায়িত্বভার দিয়েছেন। তদন্ত কার্যক্রম চলমান।
আদালত সূত্র জানায়, ১৫ নভেম্বর বিকেলে আসামি জিয়াউরকে যখন বিচারকের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামি বিচারকের কাছে ওসির চাঁদা দাবির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। পাশাপাশি আগের মামলায় কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় কারাগার থেকে দেওয়া রশিদ বের করে দেখান। সেখানে ছাড়া পাওয়ার সময় উল্লেখ ছিল ১০টা ৫৮ মিনিট। কিন্তু কোতোয়ালি থানা–পুলিশ মামলার নথিতে সংযুক্ত ফরওয়ার্ডিংয়ে (আসামির চালানপত্র) আসামিকে আটকের সময় দেখিয়েছে ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট।
এ ঘটনায় মামলার নথিতে সংযুক্ত পুলিশ ফরওয়ার্ডিং পরিবর্তন করে নতুন ফরওয়ার্ডিং সংযুক্ত করে পুলিশ। সেখানে আসামিকে আটকের সময় ও স্থান বদলে দেওয়া হয়। এ অপরাধের জন্য পুলিশের উপপরিদর্শক (জিআরও) জাহিরুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন আদালত।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ১৫ নভেম্বর সকালে আসামি জিয়াউর রহমানকে আদালতে চালানমূলে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ফরওয়ার্ডিংয়ে স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট বিচারক কোতোয়ালি থানার জিআরওর কাছে তা হস্তান্তরও করেন। পরদিন আবার বিচারকের সামনে পুলিশ ফরওয়ার্ডিং স্বাক্ষর করার জন্য নিয়ে গেলে বিচারক সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে ফরওয়ার্ডিং পরিবর্তনের (আটকের সময় ও স্থান) বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন পুলিশ কর্মকর্তা বিচারকের কাছে নথিতে সংযুক্ত আগের পুলিশ ফরওয়ার্ডিং ছিঁড়ে ফেলা এবং স্থান ও সময় (নতুন ফরওয়ার্ডিংয়ে আটকের সময় দেখানো হয়েছে বেলা ১টা ৪৫ মিনিট) বদলে নতুনভাবে ফরওয়ার্ডিং সংযুক্ত করার কথা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া দিনাজপুরের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো বিষয়ে আদালত তদন্ত করতে পারেন। বিষয়টি তিনি জানেন। পিবিআই তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট মামলার নথিতে পুলিশ ফরওয়ার্ডিং পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানান।