মনপুরায় সিত্রাংয়ের প্রভাব

দুর্বল ও নিচু বাঁধে ক্ষতি বেশি 

মনপুরা শহরের কাছে সাড়ে ১০ কিলোমিটার বাঁধ দুর্বল ও নিচু। এতে এ এলাকার মানুষের ভোগান্তি বেশি।   

বাঁধের মাটি ক্ষয়ে ভূমির সঙ্গে সমান হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার মনপুরার হাজিরহাট ল্যান্ড স্টেশন এলাকায়
 ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে এবার উপকূলে নদ-নদীর জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল কম। এরপরও ভোলার মনপুরা শহরের হাজিরহাট বাজারসহ তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ।

স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, মনপুরা উপজেলার ৭২ কিলোমিটার বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ও নিচু মনপুরা শহরের কাছে সাড়ে ১০ কিলোমিটার বাঁধ। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই এলাকার মানুষের ভোগান্তি বেশি। 

গত সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। এরপর রাত ৯টার পর মূল অংশ আঘাত হানে। রাত একটার পর উপকূলে এর প্রভাব কমে আসে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজারে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হয় ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার। এর কাছাকাছি সময়ে ভোলায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ৬৫ কিলোমিটার। 

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, মনপুরার পুরোনো হাসপাতালের উত্তর পাশ থেকে দক্ষিণের হাজিরহাট ল্যান্ডিং স্টেশন হয়ে দারোগার পাড়, রাহাতের বাড়ির কাছে, সাকুচিয়া হাজিরহাট সংযোগ সড়ক কাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পর্যন্ত রিং বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। পূর্ব সোনার চর উপজেলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নেজামুল হকের বাড়ির সামনের এলাকায় একাধিক স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে।

চর যতিন গ্রামের বাসিন্দা নুরনবী মাঝি বলেন, ‘এই বান্দের (বাঁধ) বয়স কম কোইররা অইলেও বিশ-বাইশ বছর।  বছরের পর বছর বৃষ্টির পানিত ধুই ধুই বান (বাঁধ) আর রাস্তা হমান অই গেছে। হিয়ার লাই বান্দের উরপে দি পানি ডুইকছে।’ 

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত সোমবার দিনভর বৃষ্টি হয়। বিকেল থেকে বাতাসের তীব্রতা বাড়ে। তখন ভাটা থাকায় পানি তেমন ওঠেনি। রাত ১০ দিকে যখন জোয়ার শুরু হয়। ইতিমধ্যে বাতাসের গতিবেগ কমে যায়। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে বাঁধ উপচে পানি ঢোকে। তখন বাতাসের গতিবেগ বেশি হলে পানিতে সব ভেসে যেত। যেসব স্থানে বাঁধ দুর্বল ছিল, সেখানে ভেঙে গেছে। আর যেখানে বাঁধ নিচু ছিল, সেখান থেকে পানি প্রবেশ করেছে।

হাজির হাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য ইউনুস শরীফ বলেন, বাঁধের উচ্চতা হওয়া উচিত নদীর তীর থেকে ৮ ফুট। প্রস্থ ৬-৭ ফুট এবং নদীর দিকে ঢাল ২৫-৩০ ফুট। কিন্তু হাজিপুর শহর রক্ষা বাঁধের আকার সাপের মতো, আঁকাবাঁকা, কোথাও বাঁধ আছে, কোথাও নেই। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এখন অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি ৬-৭ ফুট উঁচু হয়। ফলে সহজেই বাঁধ উপচে পানি ঢোকে। 

মনপুরা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে বাজারের ব্যবসায়ীদের দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে বাতাস থাকলে ক্ষতি আরও বেশি হতে পারত। মানুষের নিরাপত্তার জন্য টেকসই বাঁধ দরকার।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঠিকমতো মেরামত করে না বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে পাউবোর ভোলা কার্যালয়ের (বিভাগ-২) উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে। মানুষ নিজেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বাঁধ কেটে রাস্তা বানায়। বাঁধের ওপর ঘরবাড়ি তুলে বাস করছে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, সোমবার রাতে জোয়ারের গড় উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার অর্থাৎ প্রায় ৮ ফুট। এ সময় মনপুরা উপজেলা শহর রক্ষা বাঁধের কয়েক স্থানে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। শহরের হাজিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতিমাবাদ ও তজুমদ্দিনের দুটি অংশে ভাঙা জলকপাট (স্লুইসগেট) দিয়ে মেঘনার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। 

পাউবোর ভোলা কার্যালয়ের (বিভাগ-২) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল আখতার বলেন, মনপুরা শহর রক্ষা বাঁধের বয়স ২০ বছরের বেশি। পুরোনো, নিচু ও দুর্বল হওয়ায় বাঁধ ভেঙে গেছে। এখানে বাঁধ নির্মাণের জন্য এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়ে আছে। মন্ত্রণালয় চাইলে সামনে দরপত্র ডেকে মানসম্পন্ন বাঁধ নির্মাণ হবে।