নরসিংদীতে সড়ক অবরোধ করে খায়রুল কবিরকে আদালতে প্রবেশে বাধা, আইনজীবীদের গাড়ি ভাঙচুর

নরসিংদীতে খায়রুল কবিরকে আদালতে ঢুকতে বাধা দেন জেলা ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা–কর্মীরা। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের বহনকারী তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বৃহস্পতিবার শহরের স্টেডিয়াম–সংলগ্ন সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীতে ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের মিছিলে দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলিতে দুজন নিহতের ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়েছিলেন। আগামী শনিবার জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। শেষ কার্যদিবস হওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নরসিংদী আদালতে আত্মসমর্পণ করে স্থায়ী জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু খায়রুল কবিরের আদালতে প্রবেশ ঠেকাতে স্টেডিয়াম-সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করেন শতাধিক পদবঞ্চিত নেতা-কর্মী।

আদালতে যাওয়ার পথে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের বহনকারী তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং অন্তত ১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় পাঁচজন আইনজীবীকে মারধর করা হয়। সর্বশেষ বেলা দুইটার পর পুলিশের সহযোগিতায় আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন খায়রুল কবির। বেলা তিনটার দিকে তিনি জামিন পান। আহত আইনজীবীরা হলেন আকলিমা আক্তার, জোনায়েদ উল্লাহ, হোসনে মোবারক, আবদুস সাত্তার ও রোকেয়া আক্তার।

জেলা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাইন উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শহরের স্টেডিয়াম-সংলগ্ন সড়কে খায়রুল কবিরের বিরুদ্ধে শুয়ে-বসে কাফনের কাপড় পরে নানা ধরনের স্লোগান দেন পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা। তাঁরা দলে দলে ভাগ হয়ে উপজেলা মোড় থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় জেলা গোয়েন্দা শাখাসহ পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে আদালত ফটকের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

গত ২৫ মে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শহরের জেলখানা মোড়ে বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে ঢোকার পথে দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলিতে জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছাদিকুর রহমান ও তাঁর অনুসারী আশরাফুল হক (২২) নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত ছাদিকুরের ভাই আলতাফ হোসেন বাদী হয়ে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির, তাঁর স্ত্রী শিরিন সুলতানাসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ এবং ৩৫ থেকে ৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এখন পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত ৯ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাইন উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শহরের স্টেডিয়াম-সংলগ্ন সড়কে খায়রুল কবিরের বিরুদ্ধে শুয়ে-বসে কাফনের কাপড় পরে নানা ধরনের স্লোগান দেন পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা

প্রত্যক্ষদর্শী ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলায় উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন পাওয়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবিরের জামিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে শনিবার। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস হওয়ায় আজ নরসিংদী আদালতে আত্মসমর্পণ করে স্থায়ী জামিন চাওয়ার শেষ দিন তাঁর। তিনি যাতে আজ আদালতে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেন পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা। সেই উপলক্ষে সকাল ৯টার দিকে শহরের উপজেলা মোড় থেকে কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে একদল কিশোর-তরুণ তাঁর বিচার চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে আসেন। সেখানে পাঁচ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে তাঁরা খায়রুল কবিরের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।

দুপুর ১২টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের বহনকারী দুটি মাইক্রোবাস ও একটি ব্যক্তিগত গাড়ি তাঁদের সামনে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা বাধা দেন। এ সময় গাড়ি তিনটির সব কটি জানালার কাচ ভেঙে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয় পেয়ে তাঁদের পাঁচজনকে কিল-ঘুষি ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। তাঁদের নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গাড়ি তিনটির ভেতরে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অন্তত ৩০ জন আইনজীবী। বেলা ২টার পর পুলিশ সড়কে অবস্থান নেওয়া নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দিলে খায়রুল কবির আদালত চত্বরে প্রবেশ করেন। পরে শুনানি শেষে বেলা ৩টার দিকে জেলা ও দায়রা জজ মোশতাক আহম্মেদের আদালত তাঁকে জামিন দেন।

আসামিপক্ষ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইলতুৎমিশ সওদাগর বলেন, জেলখানার মোড় থেকে আদালতে যাওয়ার পথে স্টেডিয়ামের সামনে গেলে সড়কে অবস্থান নেওয়া দুষ্কৃতকারীরা তাঁদের তিনটি গাড়ি থামিয়ে ভাঙচুর চালায় এবং পাঁচজনকে মারধর করে। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। পুলিশের সামনেই গাড়ি ভাঙচুর ও আইনজীবীদের মারধরের ঘটনা ঘটে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়েও তাঁদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, অথর্বদের নিয়ে জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। তাঁদের আন্দোলনে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের দুই সহযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করেছে। ওই মামলার প্রধান আসামি খায়রুল কবিরসহ সব আসামির গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে তাঁরা কাফনের কাপড় পরে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।

ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা গাড়ি ভাঙচুরের সময় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন আইনজীবীকেও মারধর করেন। পরে পুলিশের সহযোগিতায় খায়রুল কবির আদালতে যান

জামিন পাওয়ার পর খায়রুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতে উপস্থিত হয়ে আমি যাতে আত্মসমর্পণ করতে না পারি, সে জন্য পুলিশের সহযোগিতায় সব চেষ্টায় তাঁরা করেছেন। আমার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আদালতে আসা আইনজীবীদের মারধর ও গাড়ি ভাঙচুর পর্যন্ত করেছেন। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সত্যকে চাপা রাখা যায় না। তাই তাঁরা শেষ পর্যন্ত সফল হননি।’

নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) এ কে এম শহিদুল ইসলাম বলেন, খায়রুল কবিরের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়ার বিষয়টি পুলিশ জানত। নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই তাঁরা আদালত ফটকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছিলেন। সড়কে গাড়ি ভাঙচুরের বিষয়টি শুনেছেন। তবে এখনো কোনো অভিযোগ পাননি।

২৬ জানুয়ারি জেলা ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী মাইন উদ্দিন ভূঁইয়াকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পদ দেওয়া হয়। এতে তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে আগুন দেন এবং পরে ভাঙচুর করেন। এরপর কমিটি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন পদবঞ্চিতরা। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মে বিকেলে পদবঞ্চিত নেতাদের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের করলে দুর্বৃত্তের গুলিতে দুজন নিহত হন।