মো. হিরণ মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার কলকলি গ্রামে। ২৫ বছর আগে সিলেট শহরে এসেছিলেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরে থাকলেও মন পড়ে থাকে গ্রামে। সেখানেই থাকেন বয়স্ক মা। তাঁকে দেখতে কয়েক মাস পরপর যান। গ্রামের মেঠো পথ, বিল, বিচিত্র সব পাখি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে কয়েকটা দিন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটিয়ে ফিরে আসেন শহরে। আবার সেই কর্মব্যস্ত জীবনে জড়িয়ে পড়েন।
হিরণ যখন সিলেট শহরে আসেন, তখন মিষ্টির কারিগর হিসেবে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে কাজ করতেন। দীর্ঘদিন এই কাজ শেষে গত বছর নিজেই চালু করেন ভ্রাম্যমাণ একটি দোকান। সেখানে গরুর মাংসের হালিম ও চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি রুটি বিক্রি করতে থাকেন। হিরণের সুনাম অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়ে। সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় পূবালী ব্যাংকের পাশের ফুটপাত ঘেঁষে থাকা হিরণের ভ্রাম্যমাণ হালিমের দোকানের পাশে এখন তাই খাদ্যরসিকদের ভিড় লেগে থাকে।
হিরণের দোকানের নাম ‘শাহজালাল কোয়ালিটি হালিম’। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁর দোকান খোলা থাকে। হিরণ জানান, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ বাটি হালিম বিক্রি হয়। প্রতি বাটি হালিম ৩০ টাকা এবং একেকটি রুটি ১০ টাকা। এখান থেকে অনেকে পার্সেলও নেন। ৪০ টাকা, ৮০ টাকা এবং ১৬০ টাকার পার্সেল নেওয়া যায়। খরচ বাদে প্রতিদিন হিরণের আয় হয় গড়ে ১ হাজার টাকা। এ আয় দিয়েই সংসার চালাতে হয় তাঁকে। বাড়িতে মায়ের জন্যও টাকা পাঠান তিনি।
সম্প্রতি রাত নয়টার দিকে হিরণের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কসংলগ্ন ফুটপাত ঘেঁষে বেশ কয়েকটি চেয়ার পেতে রেখেছেন হিরণ। সেখানে বসে বসে নানা বয়সী নারী ও পুরুষ হালিম-রুটি খাচ্ছেন। অনেকে বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছেন। খাদ্যরসিকদের চাহিদা অনুযায়ী একের পর এক হালিম ও রুটি পরিবেশন করছেন হিরণ। অনেককে আবার বাড়ির জন্য হালিম ও রুটি পার্সেল করে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে।
সিলেট নগরের মেন্দিবাগ এলাকায় ৫ হাজার ২০০ টাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন ৪৯ বছর বয়সী হিরণ। সেখানেই স্ত্রী ও এক বছর বয়সী এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। প্রথম স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে আট থেকে নয় বছর আগে। হিরণ বলেন, ব্যবসা থেকে যে টাকা তাঁর আয় হয়, তা দিয়ে মোটামুটি ভালোই তাঁর দিন কাটছে। তবে এই শহুরে জীবন তাঁর কাছে একঘেয়ে লাগে। ভালো জীবিকার বিকল্প না থাকায় শহরে আছেন। তাই গ্রামের জীবন তাঁকে প্রতিনিয়ত টানলেও ফিরে যেতে পারেন না।
হিরণ মিয়া বলেন, ‘আমি হালিম বানাই গরুর নলা ও বট দিয়া। রুটি বানাই চালের গুঁড়া দিয়া। এসব খাওনের প্রতি আকর্ষণ আছে মাইনষের। অনেকে নিয়মিত এখানে খাইতে আসে। আমি এক দিন না আইলে কাস্টমাররা ফোন দেয়। মনে হইতাছে এই ব্যবসা ড্যাম্প (নষ্ট) হইত না। যদি ড্যাম্প অয়, তাইলে আরেক ব্যবসা ধরমু। আমি ভালা মিষ্টি আর খাওনদাওন বানাইতে (প্রস্তুত করতে) পারি। একটা না একটা ব্যবসা জমি (জমে) যাইব আমার। তবে দিন দিন জিনিসপত্রের দাম যা বাড়তাছে, আগের মতো ভালো কইরা আর চলতাম পারি না। চলতে গিয়া হিমশিম খাইতে হয়।’