দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ডুগডুগি এলএসডি (খাদ্যগুদাম) থেকে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি), নিরাপত্তা প্রহরী ও কুলি সর্দারের যোগসাজশে ১০ হাজার ৬৬ বস্তা সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি তাঁদের বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইউনুছ আলী মণ্ডল। এ ঘটনার পর গত দুই সপ্তাহ কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন আনোয়ারা বেগম।
এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার সকালে ইউনুস আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডুগডুগি এলএসডি (খাদ্যগুদাম) থেকে চাল আত্মসাতের অভিযোগে মামলার ব্যাপারে ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ও জেলা খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। চাল আত্মসাতের অভিযোগে খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম, খাদ্যগুদামের নিরাপত্তা প্রহরী মফিজুল ইসলাম ও কুলি সর্দার শাহিনুর আলমের বিরুদ্ধে থানায় আজ (মঙ্গলবার) মামলা করা হবে।’
খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমের (৫৯) বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার নুনিয়াপাড়া গ্রামে; স্বামীর নাম আবদুল মতিন মণ্ডল। তিনি পাঁচ বছর ধরে ওই খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি চাল আত্মসাতের ঘটনার পর থেকে নোটিশ পাঠিয়ে, এমনকি তাঁর (আনোয়ারা) নিজ বাড়িতে গিয়েও তাঁর খোঁজ পাননি খাদ্য দপ্তর কর্তৃপক্ষ। আনোয়ারা বেগম তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ রেখেছেন। এ ঘটনায় ১ মে ঘোড়াঘাট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইউনুস আলী মণ্ডল ঘোড়াঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
ওই জিডি এবং ইউনুছ আলী মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল সকালে খাদ্যগুদামে পাক্ষিক পরিদর্শনে যান ইউনুছ আলী। ওই দিন খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) আনোয়ারা বেগম সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শনকালে তিনি খাদ্যগুদামের ভেতরে চালের খামাল এলোমেলো দেখতে পান। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেন ইউনুস আলী মণ্ডল। তদন্তের জন্য গত ২৮ এপ্রিল জেলা সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন। গত বৃহস্পতিবার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসানের উপস্থিতিতে ডুগডুগি খাদ্যগুদামের (এলএসডি) তালা ভেঙে চালের হিসাব মেলানোর কাজ শুরু করে ওই তদন্ত কমিটি। গত সোমবার সন্ধ্যা তদন্ত শেষ হয়।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, খাদ্যগুদামের বুক ব্যালেন্স অনুযায়ী গুদামে ৩১ হাজার ৫৮৪ বস্তায় ১ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন ১৫৫ কেজি চাল রেকর্ড থাকার কথা। কিন্তু সেখানে ২১ হাজার ৫১৮ বস্তায় ৭৪৫ মেট্রিক টন ১৪ কেজি চাল মজুদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১০ হাজার ৬৬ বস্তায় ৩১৯ মেট্রিক টন ১৪১ কেজি চাল ঘাটতি রয়েছে। প্রতি মেট্রিক টন চালের মূল্য ৫২ হাজার ৪৭২ টাকা ধরে ৩১৯ মেট্রিক টন ১৪১ কেজি চালের মূল্য প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৫৯ টাকা।
এ ছাড়া, খাদ্যগুদামে ৫০ কেজি চাল ধারণের ৪ হাজার ২৭৮টি খালি বস্তা ঘাটতি পাওয়া যায়। প্রতিটি খালি বস্তার মূল্য ৯০ টাকা হিসেবে ঘাটতি বস্তার মূল্য দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার ২০ টাকা। সেই হিসাবে চাল ও খালি বস্তার মূল্য ধরে মোট আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৭১ লাখ ৩১ হাজার ২৭৯ টাকা। তদন্তে চাল আত্মসাতের সঙ্গে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) আনোয়ারা বেগম, খাদ্যগুদামের নিরাপত্তা প্রহরী মফিজুল ইসলাম (৩২) ও খাদ্যগুদামের কুলি সর্দার শাহিনুর আলমের (৩৫) জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের এক খাদ্য পরিদর্শক জানান, সাধারণত ওসি এলএসডিরা এক স্থানে দুই বছরের বেশি চাকরিতে থাকেন না। অথচ আনোয়ারা বেগম পাঁচ বছর একই কর্মস্থলে রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মাসে দুবার গুদাম পরিদর্শন করার কথা। সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল গুদাম পরিদর্শন করা হয়েছিল। এর আগে গুদাম পরিদর্শন করা হয়েছিল ৩১ মার্চ।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও দিনাজপুর জেলা সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে গুদামের তালা ভেঙে চালের বস্তা গণনা করা হয়েছে। চাল আত্মসাতের সঙ্গে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমসহ তিনজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিষয়টি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দেওয়া হবে।’