ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানো একমাত্র ছেলেটি কারাগারে, দিশাহারা মা

নাসরিন আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

‘আমার ছেলে অপরাধী হলে মেনে নিতাম। ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছেলেকে কারাগারে যেতে হলো। ছেলের মুক্তি না হলে আমাকেও কারাগারে নিয়ে যান। ছেলে ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার আর কেউ নাই।'

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললেন ৫৫ বছর বয়সী বিধবা নাসরিন আক্তার। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয় কিডনি রোগী নাসরিন আক্তারকে। তিনি সাত বছর ধরে এভাবে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্বলহীন এই নারীর একমাত্র অবলম্বন ছিল মাদ্রাসাপড়ুয়া ২২ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে। তাঁর নাম মোহাম্মদ মুস্তাকিম। তাঁর টিউশনির টাকাতেই চলত নাসরিন আক্তারের ডায়ালাইসিসের খরচ। কিন্তু গত মঙ্গলবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে তিনি।

ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি ও সরকারিভাবে ভর্তুকি ফি কমিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে কিডনি রোগীর স্বজনদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সরকারি কাজে বাধা দান ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। একমাত্র ছেলে কারাগারে থাকায় এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নাসরিন আক্তার।

নাসরিনের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির উপজেলার ধর্মপুরে। প্রবাসী স্বামী খালেদ আজম ২০১৪ সালে মারা যান। এরপর সন্তানদের নিয়ে হাটহাজারীর লালিয়ারহাট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। ১০ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী এক মেয়ে ও তাঁকে দেখাশোনা করেন মুস্তাকিম।

মুস্তাকিম দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন লালিয়ারহাট হোসাইনিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অষ্টম শ্রেণি থেকে টিউশনি করে মুস্তাকিম মায়ের চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ চালিয়ে আসছেন। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি।

অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের লালিয়ারহাট বাজারের পশ্চিম দিকে কবির কোম্পানির বাড়িতে ছোট দুটি কক্ষে মাকে নিয়ে ভাড়া থাকেন মুস্তাকিম। এই প্রতিবেদক গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে লালিয়ারহাট গেলে স্থানীয় লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানান।


স্থানীয় কলেজছাত্র সৈয়দ তানভীরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পড়াশোনা আর টিউশনি করে দিন কাটত মুস্তাকিমের। করোনার সময় গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর মতো ছেলে হয় না।

তানভীরুল আলমের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে জড়ো হন আরও ছয় থেকে সাতজন লোক। সবার কথা একটাই, মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করলে ছেলেকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো। বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় তাঁরা দেখেছেন, পুলিশই মুস্তাকিমকে মেরেছে।

পরে মুস্তাকিমদের ভাড়া ঘরে গেলে আশপাশের লোকজন জানায় তিনি কারাগারে থাকায় তাঁর মা তাঁদের আত্মীয় মনসুর আলমের বাসায় রয়েছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের জন্য বসে কান্না করছেন নাসরিন আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রতিবন্ধী এক মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে দিন কাটত তাঁর। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে গেলে সঙ্গে থাকতেন ছেলে মুস্তাকিম। খরচ দিতেন ছেলের টিউশনির টাকায়। আর কিছু টাকা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য নিতেন।

মঙ্গলবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাসরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, একেকবার ডায়ালাইসিস করাতে গেলে গাড়িভাড়াসহ তাঁর সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। হঠাৎ ডায়ালাইসিস ফি বাড়ানোর ঘোষণায় তাঁরা হতভম্ব হয়ে পড়েন।

বিভিন্ন রোগীর স্বজনেরা এর প্রতিবাদ জানান। তাঁর ছেলেও সেখানে ছিলেন। তাঁর ছেলে কিছু না করলেও হঠাৎ পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন তাঁর ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। ছেলেকে বাঁচাতে গেলে তাঁর গায়ে পুলিশের লাথি লাগে বলে দাবি করেন এই নারী।

জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে ওসি নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটকে রোগীর স্বজনেরা বিক্ষোভ শুরু করলে হাসপাতালে আসা জরুরি রোগীদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য তাঁদের সরে যেতে বলা হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভ করতে থাকা লোকজন পুলিশের ওপর চড়াও হন। অসাবধানতাবশত অন্য এক নারীর গায়ে পা লাগতে পারে। তবে নাসরিন আক্তারের গায়ে লাগেনি।

এদিকে গতকাল মুস্তাকিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশের করা রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

মুস্তাকিমকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। সংগঠনের মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ টেনেহিঁচড়ে ওই যুবককে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে পুলিশ। আগামী রোববার আবার তাঁর জামিনের আবেদন করা হবে। মাদ্রাসাশিক্ষার্থী মুস্তাকিমের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় আর কোনো মামলা নেই। পুলিশ তাঁকে মারধর করে উল্টো পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।

সেদিন যা ঘটেছিল

ডায়ালাইসিস ফি কমানোর দাবিতে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিচতলায় স্যানডোর ডায়ালাইসিস প্রাইভেট লিমিটেডের সামনে বিক্ষোভ করে আসছিলেন রোগী ও স্বজনেরা। মঙ্গলবার তাঁরা হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনের কেবি ফজলুল কাদের সড়ক অবরোধ করেন। ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশের সদস্যরা সেদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন।

মোহাম্মদ মুস্তাকিম

একপর্যায়ে ওসি নাজিম উদ্দিন হঠাৎ আন্দোলনকারী ব্যক্তিদের ওপর চড়াও হন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সময় একজনকে শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে পাশের একটি হাসপাতালের ভেতর নিয়ে যান তিনি। পুলিশের মারমুখী আচরণে মানববন্ধনে উপস্থিত লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরাও এ সময় পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন।

এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে উল্টো পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে মামলা করে। মামলায় মুস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয়ে আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়।

রোগীদের অভিযোগ, স্যানডোর এত দিন দুটি মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দিত। এর মধ্যে ভর্তুকির যে সেবা দিত, তার মূল্য ছিল ৫১০ টাকা। তা বেড়ে এখন ৫৩৫ টাকা হয়েছে।

এ ছাড়া ভর্তুকি ছাড়া ২ হাজার ৭৮৫ টাকায় যে ডায়ালাইসিস সেশন চালাত, তা করা হয়েছে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা। আবার এত দিন যাঁরা মাসে আটটি সেশন ভর্তুকি মূল্যে ডায়ালাইসিস করাতে পারতেন, তাঁদের এখন থেকে অর্ধেক বা চারটি সেশন পুরো ফিতে করতে হবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এ কারণে রোগী ও স্বজনেরা শনিবার থেকে আগের ফি এবং ভর্তুকি সেশন আগের মতো বহাল রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

ওসি নাজিমের বিচার চান নাসরিন আক্তার

ছেলেকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও তাঁকে লাথি দেওয়ার অভিযোগে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের বিচার দাবি করেন কিডনি রোগী নাসরিন আক্তার। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান তিনি। নাসরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই দুনিয়ায় ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ছেলে কারাগারে থাকায় এখন আত্মীয়ের বাসায় থাকতে হচ্ছে। আমার দেখাশোনা ও ডায়ালাইসিস করানোর মতো কেউ নেই। চিকিৎসা খরচ চালাত ছেলে।’