চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ লোকমান। ছয় সদস্যের পরিবারের খরচ একাই চালান এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তবে সম্প্রতি বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তাই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষি ওএমএস কার্যক্রম থেকে সবজি কিনেছেন তিনি। এতে বাজারের তুলনায় সাশ্রয় হয়েছে ২৫০ টাকার বেশি।
আজ সোমবার সকালে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মোহাম্মদ লোকমান বলেন, আয় দিয়ে সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাসাভাড়া, বাজার, সন্তানদের খরচ—সব মিলিয়ে টানাটানিতে সংসার চলছে। এর মধ্যে বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। এই অবস্থায় সরকারি ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে কিছু টাকা সাশ্রয় হয়।
শুধু লোকমান নন, নগরের বিভিন্ন স্থানে সরকারি সংস্থাগুলোর পণ্য বিক্রির ট্রাক ও দোকানের সামনের আশায় সারি ধরা অধিকাংশ মানুষের বক্তব্য এমন। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সব পেশার মানুষই ভুক্তভোগী। তাই বাজারের তুলনায় কম দামে পণ্য বিক্রির এসব স্থানে ক্রেতাদের সারি বড় হচ্ছে। এদিকে চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অনেকেই আবার এক স্থান থেকে খালি হাতে ফিরছেন।
বাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক দিনে সবজির দাম কিছুটা কমলেও খুচরায় এর প্রভাব নেই। ফলে মানুষ বাজার থেকে কেনাকাটা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, নগরে সরকারি-বেসরকারিভাবে সবজি ও পণ্য বিক্রির পর থেকে বাজারে ক্রেতা কমেছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বাজারে সবকিছুই এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাজার থেকে এসব স্থানে পণ্যের দামে পার্থক্য বেশি। এ কারণে এসব স্থানে মানুষের সারি দিন দিন বাড়ছে।’
চট্টগ্রামে বর্তমানে চারটি সরকারি সংস্থা দোকানে ও ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করছে। এর মধ্যে নগরের ২০টি স্থানে ট্রাকে করে সাত হাজার ভোক্তার কাছে চাল, ডাল ও তেল বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। পাশাপাশি নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে প্রতি মাসে পরিবার কার্ডের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ৫ লাখ ৩৫ হাজার ভোক্তার কাছে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। টিসিবির পাশাপাশি খাদ্য অধিদপ্তরের ২৫টি দোকানে প্রতিদিন ২৫ টন চাল ও সাড়ে ৩৭ টন আটা বিক্রি হচ্ছে।
এই দুই সংস্থা ছাড়াও বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নগরের ১০টি স্থানে আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ ছয়টি কৃষিপণ্য বিক্রি করছে ভর্তুকি মূল্যে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ছয়টি ভূমি সার্কেলের অধীনে ছয়টি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো ছাড়াও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষার্থীরাও পণ্য বিক্রি করছে।
সরেজমিন সরকারি চারটি সংস্থার পণ্য বিক্রির স্থানগুলো ঘুরে প্রতিটি স্থানে মানুষের লম্বা সারি দেখা গেছে। পণ্য বিক্রি শুরুর ঘণ্টা আগে থেকে সেখানে ব্যাগ হাতে মানুষ ভিড় করতে দেখা যায়। এসব সারিতে অধিকাংশ মানুষই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের। সাধারণ অটোরিকশাচালক থেকে শুরু করে গৃহিণী, ক্ষুদ্র দোকানি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্কুলশিক্ষকসহ সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে সারি ধরে পণ্যের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহরিয়ার আকুঞ্জী বলেন, ‘মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বরাদ্দ ৫০ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া স্থানসংখ্যা আরও ৫টি বাড়িয়ে প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ মানুষের কাছে কৃষিপণ্য বিক্রি হচ্ছে। কেউ যাতে খালি হাতে না ফেরে, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।’
গত মঙ্গলবার নগরের ৫টি স্থানে খোলাবাজারে কৃষি সবজি বিক্রি (কৃষি ওএমএস) শুরু করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। দুই দিন পর বৃহস্পতিবার থেকে নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরে ট্রাকে করে ২০টি স্থানে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। চাহিদার কথা মাথায় রেখে স্থানসংখ্যা ৫ থেকে ১০টি করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। প্রতিটি স্থানে বরাদ্দ ২০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ জন করা হয়। এরপরও চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
কর্মকর্তাদের তথ্য ও বিক্রয়ের স্থান হিসেবে, সবচেয়ে বেশি চাহিদা নগরের বহদ্দারহাট, ষোলোশহর, চকবাজার, কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, আগ্রাবাদ, ইপিজেডসহ বেশ কিছু এলাকায়। জানা গেছে, এসব এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা নগরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি। ফলে চাহিদার বিপরীতে এসব এলাকায় পণ্য বিক্রির স্থান বেশি।
মূলত বাজার থেকে মূল্য কম হওয়ায় চাহিদা বেশি এসব স্থানে। পণ্যমূল্য যাচাই করে দেখা গেছে, বাজার থেকে অন্তত ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে চাল ও আটা বিক্রি করছে খাদ্য অধিদপ্তর। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ৪৯০ টাকার প্যাকেজে ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও তিন পদের সবজি বিক্রি হচ্ছে। বাজারে একই পরিমাণ পণ্যের দাম অন্তত ৬৫০ টাকা। অন্যদিকে টিসিবির ৪৭০ টাকার প্যাকেজের চাল, ডাল ও ভোজ্যতেলের মূল্য বাজারে ৭৫০ টাকার বেশি।
সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে অনেক পণ্যের দাম কমেছে গত কয়েক দিনে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বৈঠক হয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টির প্রভাবে কৃষক পর্যায়ে দাম বেড়েছে। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।’