মারা যাওয়া ফয়সাল খানের বোনের বাসায় ডিবি পুলিশের অভিযানের সময় সিসিটিভিতে বাদীপক্ষের দুজন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেখা যায়
মারা যাওয়া ফয়সাল খানের বোনের বাসায় ডিবি পুলিশের অভিযানের সময় সিসিটিভিতে বাদীপক্ষের দুজন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেখা যায়

ময়মনসিংহে যুবকের মৃত্যু

ডিবির ১৮ মিনিটের অভিযানে দুজনের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন

ময়মনসিংহের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফয়সাল খানের (৩০) মৃত্যু ঘিরে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফয়সাল ও তাঁর চার স্বজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয় ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে। কিন্তু তার আগেই রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে ফয়সালের বোনের বাসায় অভিযানে যায় ডিবি।

অভিযানে ডিবির সঙ্গে থাকা দুই ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁরা বাদীপক্ষের লোকজন। ডিবির ১৮ মিনিটের অভিযান শেষে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাঁচতলা ভবনের নিচ থেকে ফয়সালকে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বজনেরা। গত শুক্রবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

ময়মনসিংহ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এইচ এম খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী পুলিশ বাদীপক্ষের লোকজন নিয়ে অভিযানে যেতে পারে না। কোনো বাসায় তল্লাশি চালাতে হলে এলাকার গণমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিতে পারে। যেহেতু পুলিশের সঙ্গে বাইরের লোক প্রবেশ করেছে, তাঁদের দায়িত্বও পুলিশের।

ফয়সাল জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা কাশিপুর এলাকার মো. সেলিম খানের ছেলে। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে নগরের কেওয়াটখালী পাওয়ার হাউস রোডে বড় বোনের বাসায় থেকে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন তিনি। ফয়সালের সঙ্গে প্রায় চার বছর প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাঁর এলাকার এক তরুণীর। ১৫ নভেম্বর তরুণীর বিয়ে ঠিক হওয়ায় ফয়সাল বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য তরুণীর বাবা থানা ও ডিবিতে পর্নোগ্রাফি আইনে অভিযোগ দেন। কিন্তু মামলা রেকর্ড হওয়ার আগেই বোনের বাসায় অভিযানে যায় ডিবি।

অভিযানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ১০ নভেম্বর রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে বাসার নিচের কলাপসিবল গেট খুলে দিচ্ছেন ফয়সালের ভগ্নিপতি মোহসিনুল হক। এ সময় ডিবি পুলিশ লেখা কটি পরিহিত চারজন, কটিবিহীন চারজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে যান। পোশাকবিহীন একজনের হাতের ওয়াকিটকি দেখে পুলিশ সদস্য মনে হয়। বাকি তিনজনের মধ্যে শেষের দিকে থাকা দুজনের একজনের মুখে মাস্ক ও একজনের মাথায় ক্যাপ পরা দেখা যায়। ডিবি নিশ্চিত করেছে, অভিযানে মোট ছয়জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। অন্য দুজনের একজন ওই তরুণীর খালাতো ভাই আসিফ সাইফুল্লাহ বলে জানিয়েছেন ফয়সালের স্বজনেরা। অন্যজনের পরিচয় মেলেনি।

ফয়সাল খান

ডিবির সঙ্গে থাকা আসিফ ও মুখে মাস্ক পরা ব্যক্তি সরাসরি বাসার ছাদে চলে যান বলে জানান ফয়সালের ভগ্নিপতি মোহসিনুল হক। তিনি বলেন, বাসার বাইরে ডিবি পুলিশ দেখে দোতলার ভিন্ন দরজা দিয়ে ফয়সাল পাঁচতলায় ও তাঁর স্ত্রী তৃতীয় তলায় চলে যান। এর আগে বাসার নিচে ডিবি জানায়, ফয়সাল ও তাঁর বোনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাঁদের ধরতে হবে। ডিবি বাসায় তল্লাশি শেষে তৃতীয় তলায় ওঠে। তখন ছাদের দিক থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন আসিফ ও সঙ্গে থাকা অন্যজন। তাঁরা বলতে থাকেন ওপরে ফয়সাল নেই। পরে বাসা ত্যাগ করেন ডিবি ও সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা।

মোহসিনুল হক বলেন, ‘ওই দুজন ছাদে যাবে তা কল্পনায় ছিল না আমাদের। ফয়সাল এমন অপরাধী নয় যে লাফ দেবে। সিভিলিয়ান যদি ডিবির সঙ্গে না ঢুকত, ওপরে না যেত, তাহলে ধরে নিতাম ডিবির কারণে সে লাফ দিয়েছে। এখানেই তো আমাদের সন্দেহ বেড়ে গেল। সিভিলিয়ানরা আগে থেকেই কেন বাসার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল? ডিবি কেন তাঁদের বাসায় নিয়ে এল, তারা কেন ছাদে গেল? আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারত বা সবাই একসঙ্গে যেতে পারত, এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছি না।’

এ ঘটনায় ১২ নভেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় ফয়সালের বাবা মো. সেলিম খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাসায় ঢুকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে ফয়সালকে বাসার নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। মামলায় তরুণীর বাবাসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনায় আজ রোববার বেলা সোয়া তিনটা পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম খান।

মোহসিনুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রথমে আমাদের মামলা নিতে চায়নি। পুলিশ এখনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারছে না। একজনকে গ্রেপ্তার করলেও কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, বেরিয়ে আসত। পুলিশ কেন আমাদের শুধু দেখানোর মতো ভূমিকা পালন করছে। আমরা গেলে শুধু বলে এই তথ্য দেন, সেই তথ্য দেন। আমরা চাচ্ছি ঘটনার সঠিকতা বের হোক। যারা জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক।’

ময়মনসিংহ ডিবির ওসি মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপপরিদর্শক (এসআই) সোহরাব উদ্দিন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখালে তিনি ছয়জনকে পুলিশ সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করেন। বাকি দুজন সোর্স হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান। বাইরের লোক নিয়ে অভিযানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছিল।’ তাঁরা কেন ছাদে গেল প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেই জন্যই তো মামলা হয়েছে।’

মামলা নথিভুক্তির আগে ডিবির অভিযান, পুলিশ সদস্যের সঙ্গে বাইরের লোক যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বজনেরা। ফয়সাল খান, তাঁর তিন বোন ও চাচির বিরুদ্ধে তরুণীর বাবার করা মামলাটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলায় সংবাদপ্রাপ্তির তারিখ ও সময়ের জায়গায় ১১ নভেম্বর ০৫ মিনিট লেখা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে মামলা নথিভুক্ত হয়। থানা–পুলিশ রাত ১২টা ৫ মিনিটে মেয়ের বাবার কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছে দেখালেও ডিবি রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে অভিযানে যায়।

ফয়সালের বাবা মো. সেলিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার দুদিন আগেও আমার এক ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল ওরা (তরুণীর পরিবার)। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমার ছেলেকে মেরেছে। তাকে মেরে ফেলার নিয়তেই গেছে, না থাকলে ডিবির অভিযানে অন্য লোক যায় কেন?’

জানতে চাইলে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতেই সেখানে ডিবিকে পাঠানো হয়েছিল। চিনিয়ে দেওয়ার জন্য দুজন সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশকে রেখে তাঁদের ওপরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ঘটনা জানার পরই মামলা নেওয়া হয়েছে।