কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

যেসব কারণে এবার পাগলা মসজিদে দানের টাকা বেশি পাওয়া গেল

সাঈদদের বাড়িতে একটি ছাগল ছিল। সাঈদের মা মানত করেছিলেন, ছাগলের বাচ্চা হলে প্রথম বাচ্চাটি কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদে দান করবেন। নিয়ত অনুযায়ী আজ রোববার ছাগলের বাচ্চা নিয়ে সাঈদ ও তাঁর মা পাগলা মসজিদে দান করতে আসেন। দান করে যাওয়ার সময় সাঈদ বলেন, মায়ের মানতের ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে তাঁর ভালো লাগছে।

রবিন দেবনাথ নামের সনাতন ধর্মের একজন মোটরসাইকেলে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে পাগলা মসজিদে আসেন। একে একে সবাই মিলে বেশ কিছু টাকা লোহার সিন্দুকে ঢোকান। জিজ্ঞেস করতেই রবিন দেবনাথ বললেন, সন্তানের ভবিষ্যতের উন্নতি কামনা ও নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে পাগলা মসজিদে এসেছেন। এভাবেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এসে পাগলা মসজিদে টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালংকার ও গবাদিপশু দান করেন।

চার মাসের মাথায় গতকাল শনিবার পাগলা মসজিদের দানসিন্দুক খুলে রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দানসিন্দুকে মিলেছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার। এর আগে গত ৭ জানুয়ারি পাগলা মসজিদের ৮টি দানসিন্দুকে ১৬ বস্তা টাকা পাওয়া যায়। তখন দিনভর গুনে পাওয়া গিয়েছিল ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা।

এবার দানের টাকা বেশি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, প্রথমত, রমজান মাসে মানুষ বেশি দান করে থাকেন। এ ছাড়া এবার শবে বরাত, শবে কদর ও ঈদের বিশেষ দিন থাকায় টাকার পরিমাণটা বেশি হয়েছে। অনেকে এক দিনেই বিপুল পরিমাণ টাকা দান করেছেন। রোজার সময় এক ব্যক্তি দুটি থলেতে টাকা নিয়ে সিন্দুকে রাখতে আসেন। তাঁদের একটি বড় মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন আরও বলেন, রোজার সময় হওয়ায় প্রকাশ্যে গোপনে অনেকে বেশি বেশি দান করেছেন। তাই এবার দানের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দানের টাকা রূপালী ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দানবাক্সে জমা পড়া বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছে। এ টাকা দিয়ে দ্রুত ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। যাতে প্রায় ৪০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান বলেন, সওয়াবের নিয়তে মসজিদে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে দান-খয়রাত করে থাকেন। সঠিক নিয়তে দান করলে মানুষের ইচ্ছা, মনের আশা ও মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। সেই বিশ্বাস থেকে মানুষ এখানে টাকাপয়সা, স্বর্ণালংকার, গবাদিপশুসহ বিভিন্ন জিনিস দান করেন।

জেলা শহরের নরসুন্দা নদীতীরের ঐতিহাসিক মসজিদটিতে লোহার আটটি দানসিন্দুক আছে। তিন মাস পরপর এসব সিন্দুক খোলার কথা। পবিত্র রমজান মাস ও ঈদের কারণে এবার চার মাসের মাথায় খোলা হয়েছে। এর মধ্যে রমজান মাস ও ঈদুল ফিতর থাকায় এবার টাকা বেশি পাওয়া গেছে।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে রোববার দুপুরে জান্নাত আক্তার নামের এক নারী পাগলা মসজিদের সিন্দুকে কিছু টাকা দান করছিলেন। উদ্দেশ্য জানতে চাইলে বললেন, প্রায় এক বছর আগে তাঁর মা আছমা আক্তার নিয়ত করেছিলেন পাগলা মসজিদে কিছু টাকা দান করবেন। সময় সুযোগের অভাবে এত দিন আসতে পারেননি। তাই আজ মায়ের মনোবাসনা পূরণ করতে পাগলা মসজিদে এসেছেন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন বলেন, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকার বলে কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তখন থেকেই সরকারের ওয়াকফের নিয়ন্ত্রণাধীন মসজিদের আর্থিক লেনদেন পরিচালিত হয়ে আসছে। এ মসজিদের অর্থ দিয়ে জেলা শহরের ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হয়। পাশাপাশি পাগলা মসজিদ, ইসলামিক কমপ্লেক্সের খরচসহ জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানায় অনুদান দেওয়া হয়।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ৬ তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স´নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১২টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর নকশা চূড়ান্ত হলেই কাজ শুরু হবে। এতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কাজ শুরুর পর এটি কমবেশি হতে পারে। তিনি বলেন, তাঁদের কাছে বর্তমানে অর্ধেক টাকা আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা কাজ শুরু করতে পারবেন। কাজ শুরু করলে বাকি টাকাও ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।