কিশোরগঞ্জে রবি দাসকে পিটিয়ে হত্যার তিন দিন পর অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা

নিহত হৃদয় রবি দাস (২২)
ছবি: সংগৃহীত

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে রবি দাস সম্প্রদায়ের হৃদয় রবি দাস (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তিন দিন পর থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হয়েছে অজ্ঞাতনামা আসামি করে। গতকাল সোমবার রাতে করিমগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন নিহত হৃদয়ের বড় ভাই বিজয় রবি দাস (২৪)।

করিমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মামলার নথিপত্রসহ প্রাথমিক তথ্য বিবরণী আজ মঙ্গলবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। আসামিদের ধরার চেষ্টা চলছে।

গত শনিবার ভোরে করিমগঞ্জে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদয় মারা যান। হৃদয় করিমগঞ্জের জয়কা বারুক বাজার এলাকার রিকশাচালক জুগেস রবি দাসের ছেলে। তিনি উপজেলার নোয়াবাদ ভূঁইয়া বাজার এলাকায় একটি সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করতেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে হৃদয় উপজেলার পাড়াবালিয়া ভূঁইয়া বাজার এলাকায় তাঁর সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এমন সময় নারী–সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে অজ্ঞাতনামা কতিপয় ব্যক্তি হৃদয়ের দোকানের সামনে এসে তাঁকে মারধর করেন। পরে সেখান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাজারের ক্লাবঘরে নিয়ে আবার মারধর করেন। মারধরের এক পর্যায়ে হৃদয় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁকে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার ভোরের দিকে মারা যান হৃদয়।

মামলার বাদী আরও উল্লেখ করেন, ‘আমার ছোট ভাই হৃদয় রবি দাস অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের মারধরের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে।’

সেদিন কী ঘটেছিল

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগে একই এলাকার একজন এতিম মুসলিম কিশোরীর (১৬) সঙ্গে হৃদয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে কিশোরীর স্বজনদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই কিশোরীর স্বজনসহ কয়েকজন হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাই শাকিল রবি দাসকে ডেকে বাজারের ক্লাবঘরে নিয়ে যান। সেখানে নোয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়াসহ পাঁচ-ছয়জন উপস্থিত ছিলেন।

শাকিল রবি দাস বলেন, ‘চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর মিয়া, বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়াসহ মুসলিম কিশোরীর দু-তিনজন স্বজন উপস্থিত থেকে আমাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে মারপিট করে। ঘণ্টাখানেক পর তিনজন চৌকিদার, একজন স্থানীয় লোকসহ আমাদের অটোরিকশায় করে সেনা ক্যাম্পে পাঠায়। অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও মারধর করা হয় আমাদের। সেনা ক্যাম্পে গেলে হৃদয়কে এক কক্ষে ও আমাকে আরেক কক্ষে রাখা হয়। হৃদয়ের কক্ষে কী ঘটনা ঘটেছে, আমি জানতে পারিনি। পরে রাত দুইটার দিকে দেখি, হৃদয়কে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হৃদয় মারা যায়।’

গত রোববার বিকেলে শাকিলের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বাঁ হাত ও ডান ঊরুতে মারধরের দাগ এবং তাঁর পরনের লুঙ্গিতে রক্তের দাগ দেখা যায়। এমন সময় তাঁর চোখমুখে আতঙ্ক ছিল। তিনি আর কিছু বলতে চাননি।

তবে চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, শুধু হৃদয়ের মুঠোফোন চেক করে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে করিমগঞ্জে সেনা ক্যাম্পে খবর দেওয়া হয়। কারণ, হৃদয়ের মুঠোফোন হোয়াটসঅ্যাপে কিশোরীর বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পরে তিনজন চৌকিদার, একজন স্থানীয় বাসিন্দাসহ একটি রিকশায় হৃদয় ও শাকিলকে করিমগঞ্জ উপজেলা কার্যালয়ের সেনা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে শুক্রবার রাত দুইটার দিকে খবর পান যে হৃদয় খুব অসুস্থ।

করিমগঞ্জের সেনা ক্যাম্পে গেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, হৃদয়কে গণপিটুনি দিয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁদের কাছে হস্তান্তর করেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে এক কিশোরীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত ও অন্যত্র পাচার করে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে তাঁর মুঠোফোনে অনেক তথ্য ছিল। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ হৃদয় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁর মুখ থেকে নেশাজাতীয় একধরনের দ্রব্যের গন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া জনগণের পিটুনি ও সেনাসদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ—সব মিলিয়ে হৃদয় অসুস্থ হয়ে গেলে তাঁকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে হৃদয় মারা যান। হৃদয় হয়তো নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের কারণে কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তবে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদন এলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে। তবে সেনাসদস্যদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে হৃদয়কে সুস্থ করে তুলতে এবং তাঁর সঙ্গে আর কারা জড়িত ছিলেন, সে বিষয়ে জানতে।