‘সালামের বয়স যহন দুই মাস, তহন ওর বাবার লগে আমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছিল। এরপর এই পোলাডারে লইয়া আমি বাঁইচ্ছা আছিলাম। বাড়ির সবাই আমারে দ্বিতীয়বার বিয়া দিতে চাইছিল। পোলাডার মুহের দিক চাইয়া করি নাই। সালাম আছিল আমার সব আশা–ভরসা। আগুনে পুইড়া আমার সালাম শেষ, সালামের লগে আমার তো সুখ, আশা-ভরসা সব শেষ হইয়া গেল।’
কথাগুলো বলতে বলতে আহাজারি করছিলেন মালয়েশিয়ায় কারখানায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক আবদুস সালামের (২৪) মা তাছলিমা বেগম। সালাম নারায়ণগঞ্জের মহিউদ্দিনের ছেলে। মা–বাবার বিচ্ছেদের পর মা তাছলিমা বেগমের সঙ্গে নানার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার রমজানবেগ এলাকায় থাকতেন তিনি। দেড় বছর আগে ধারদেনা করে মালয়েশিয়া যান তিনি। সেখানে মামা তাহের আলীর সঙ্গেই থাকতেন। সেখানে এক রাসায়নিক কারখানায় তিনি কাজ করতেন।
গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজ করার সময় ওই কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় কারখানার ভেতরে থাকা সালাম, সালামের মামাসহ তিন বাংলাদেশি শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হন। তাঁদের শরীরের অধিকাংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে মারা যান সালাম। একই ঘটনায় মারা যান সালামের মামা আবু তাহের (৩২) এবং একই গ্রামের রাজ্জাক ভূঁইয়ার ছেলে জব্বার আলী (৪২)।
সালামের মা তাছলিমা বেগম বলেন, ‘বাবার বাড়িতে থাইকা খুব কষ্ট করছি। মানুষের কৃষিজমিতে পর্যন্ত কাজ করছি। নিজে না খাইলেও পোলাডারে খাওয়ায় রাখছি। কত মানুষের কত কথা হুনছি। পোলারে আগলাইয়া রাখছি। পোলারে বড় করছি। পোলায় কইত বিদেশ যাইব, আমাগো সব কষ্ট শেষ অইব। নিজেরা আলাদা জায়গা কিনব, বাড়ি করব। ওই বাড়িতে আমারে রাখব।’
তাছলিমা বেগম আরও বলেন, ‘পোলাডার শরীরে আগুন লাগার পর বুঝতে পারছিল হয়তো অয় আর বাঁচব না। আমার লগে আর একটা কথাও কয় নাই অয়। ওর লগে যে বাংলাদেশিরা থাকত, তাগো কইছিল, ফোন দিয়া কইস আমার মায় যেন আমারে মাফ কইরা দেয়।’ বলতে বলতে কেঁদেই যাচ্ছিলেন তাছলিমা বেগম। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
কান্না শেষে কিছুটা সামলে নিয়ে তাছলিমা বেগম বলেন, ‘দেড় বছর আগে সাড়ে তিন লাখ টাকা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সুদে এনে ছেলেকে আমার ভাই আবু তাহেরের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাঠাই। প্রথম ছয় মাস কোনো কাজ করতে পারেনি সালাম। এক বছরে কিছু টাকা পাঠিয়েছিল। সুদসহ দেড় লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করছি। এখনো পাওনাদারেরা দুই লাখ টাকা পাইব। এই ধারের টাকা কেমনে শোধ করমু?’
আজ সোমবার দুপুরে নিহত সালাম ও আবু তাহেরদের বাড়িতে গিয়ে শোকের মাতম দেখা যায়। ঘরের বাইরে বসে কাঁদছিলেন সালামের মা। এক পাশে নির্বাক বসে ছিলেন সালামের নানী একই দুর্ঘটনায় গত শনিবার ভোরে মারা যাওয়া আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছা।
এক বাড়িতে দুটি মৃত্যুতে পুরো পরিবারটি ভেঙে পড়েছে। এই মৃত্যুর খবরে নির্বাক আবু তাহেরের স্ত্রী মাকসুদা বেগম। বাড়িতে স্বজনেরা এসে বারবার তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
সালাম ও আবু তাহেরের স্বজনেরা বলেন, ১০ বছর আগে মালয়েশিয়া যান আবু তাহের। গত ১০ বছর একই কোম্পানিতে কাজ করছিলেন তিনি। কোম্পানি ভালো হওয়ায় দেড় বছর আগে ভাগনে সালামকেও নিয়ে যান। দেড় বছরের কিছু সময় আগে দেশে এসে পারিবারিকভাবে মাকসুদাকে বিয়ে করেন আবু তাহের। স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছেন মাকসুদা। খাওয়াদাওয়া–কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর। একটু পরপর আবু তাহেরের জন্য কান্না করছেন তিনি।
আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছা বলেন, ‘কত মানুষের বাড়িতে, কত দুর্ঘটনার কথা হুনতাম। কোনো দিনও ভাবি নাই, আমাগো বাড়িতে এমন দুর্ঘটনা আইব। আমার পোলা আর নাতি এক দুর্ঘটনায় মইরা যাইব।’
খায়রুন নেছা তাঁর ছেলে এবং নাতির লাশ চেয়ে বলেন, ‘পোলা আর নাতি জীবিত তো আর ফিরা আইব না। বিদেশের মাটিতেও ওগো লাশ পইড়া আছে। আমাগো দেশের সরকার লাশগুলো দ্রুত আনোনের ব্যবস্থা কইরা দেওক। আমরা ওদের দেশের মাটিতে দাফন করতে পারলে, ওদের শেষ চিহ্ন কবরটা অন্তত দেখা যাইতে পারমু।’
একই দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গত শুক্রবার মারা যান সালাম ও আবু তাহেরের প্রতিবেশী জব্বার আলী (৪২)। আজ জব্বার আলীদের বাড়িতে গিয়েও শোকার্ত পরিবেশ দেখা যায়। ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক হতে পারছেন না জব্বারের স্বজনেরা।
জব্বার আলীর বাবা রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিদিন আমার ছেলে আমাকে ফোন করত। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলত। গত বুধবার গভীর রাতে আমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ফোন করেছিল। আমি জব্বারকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, আল্লাহ যার হায়াত যতক্ষণ রেখেছেন, সে ততক্ষণ বেঁচে থাকবেন। বৃহস্পতিবার সকালে জব্বার ফোন দেয়নি। আমি ফোনের আশায় থেকে নিজেই ফোন করেছিলাম। সে আর ফোন ধরেনি। দুপুরে জানতে পারলাম আমার ছেলের শরীরে আগুন লেগেছে। পরদিন শুক্রবার সে মারা যায়।’
জব্বার আলীর ভাতিজা খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ওরা তিনজন অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর সড়কে পড়ে ছিল। দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত সড়কেই পড়েছিল। যদি সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যেত, হয়তো ওরা কেউ না কেউ বেঁচে যেত। জীবিত পাইনি, এখন আমরা অন্তত লাশটা দ্রুত চাই।’
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, লাশগুলো দ্রুত কীভাবে দেশে আনা যায়, সে বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। সেই সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা করা যায়, সবটুকু করা হবে।