টেইলারিং, এমব্রয়ডারি, নকশি সেলাই, ব্লক-বাটিক, কেক তৈরিসহ ২২টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন নূরুন্নাহার
টেইলারিং, এমব্রয়ডারি, নকশি সেলাই, ব্লক-বাটিক, কেক তৈরিসহ ২২টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন নূরুন্নাহার

শখের সেলাই হয়ে গেল বাঁচার অবলম্বন

শখের বশে শিখেছিলেন সেলাইয়ের কাজ। সেই শখই এখন নূরুন্নাহার লিলির বেঁচে থাকার অবলম্বন। নিজের শেখা কাজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্য নারীদের মধ্যেও। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার অন্তত ১৭ হাজার নারী তাঁর কাছ থেকে সেলাই, বুটিকস, ব্লক-বাটিক, ফুড প্রসেসিংসহ ২২ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেন তিনি। যাঁরা কাজ শিখেছেন, তাঁদের অনেকেই এখন সফল উদ্যোক্তা।

নূরুন্নাহারের বাড়ি খুলনা নগরের দক্ষিণ টুটপাড়ার মহিবাড়ি বড় খালপাড় এলাকায়। নিজের বাড়িতেই ‘লিলি ট্রেনিং সেন্টার ও বুটিকস হাউস’ নামের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। এখন তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। গত বছর জয়িতা অন্বেষণে ‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে তাঁকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। এর আগে ২০২০ সালে জেলার ‘শ্রেষ্ঠ সমবায়ী’র পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি।

নূরুন্নাহারের জীবনের পথচলার শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের সোপানের দেখা পেয়েছেন। ছোট থাকতেই সংসারের হাল ধরতে গিয়ে নিজের দিকে তাকানোরও সময় পাননি তিনি। এসএসসি পাস করেই পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছিল। এসএসসি পাসের প্রায় এক যুগ পর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিয়েও করেছেন বেশ দেরিতে। এখন এক সন্তানের মা নূরুন্নাহার।

১৯৯৩ সালে টুটপাড়া এলাকার সুলতানা হামিদ আলী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন নূরুন্নাহার। সেখানে ব্যবহারিক পরীক্ষায় কিছু হাতের কাজ ছিল। কিন্তু কাজ না জানায় তখন কিছুই জমা দিতে পারেননি। পরে একজনের সহায়তায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় ছোট একটি গোলাপফুল এঁকে সাত দিন ধরে তা সেলাই করেছিলেন। খুব একটা ভালো না হলেও শিক্ষকেরা পুরো নম্বর দিয়েছিলেন, প্রশংসাও করেছিলেন। এতে আগ্রহ বেড়ে যায়। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই যুব উন্নয়ন ও সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডে সেলাই প্রশিক্ষণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। দুই জায়গাতেই প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে শখের বশে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। কয়েক বছর পরই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা মারা যান, মা অসুস্থ থাকায় সুখের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। পাঁচ ভাই-বোনের সবাই তখন পড়াশোনা করছেন। আয় বন্ধ হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ে পুরো পরিবার।

সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন নূরুন্নাহার

শখের বশে শেখা সেলাই দিয়ে একটু একটু করে সংসারের হাল ধরতে শুরু করেন নূরুন্নাহার। নিজের কাজের পরিধি বাড়াতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। বাড়িতেই গড়ে তোলেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রথমে চারজন শিক্ষার্থী দিয়ে কাজ শুরু করেন। টেইলারিং, এমব্রয়ডারি, নকশি সেলাই, ব্লক-বাটিক, কেক তৈরিসহ ২২টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাঁর প্রশিক্ষণ পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক নারী। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করছেন। নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সমবায় অধিদপ্তর আওতায় ১৩ বছরে প্রায় ৫০০ জনকে, এটুআই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭০০ জনকে, এসওএস শিশুপল্লিতে ১১ বছরে ১ হাজার ৩২০ জনকে, ইউএনডিপির সাত বছরের একটি প্রকল্পে প্রায় ৭০০ জনকে, এডিপির প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে খুলনার বিভিন্ন উপজেলা ও সাতক্ষীরা শ্যামনগর এলাকায় প্রায় দুই হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ঢাকা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পাবনা, গাইবান্ধা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, সিঙ্গার ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুল, প্রশিকা, উইএসএমএস প্রকল্পের আওতায় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

যখন সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করি, তখনো আমাদের সমাজে নারীর এসব কাজকে ভিন্ন চোখে দেখা হতো। অনেকেই কটু কথা বলেছেন। কিন্তু আমি দমে যাইনি। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে যা যা করা দরকার সবই করেছি।
নূরুন্নাহার, উদ্যোক্তা

নূরুন্নাহারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মাকসুদা আক্তার। এখন তিনি নিজেই উদ্যোক্তা। টুটপাড়া এলাকায় ‘মাকসুদা লেডিস টেইলার্স’ নামের একটি দোকান দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালের দিকে নূরুন্নাহারের কাছ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিই। সেই প্রশিক্ষণই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এখন আমার সংসারের খরচ আমিই বহন করতে পারি।’

নূরুন্নাহার বলেন, ‘যখন সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করি, তখনো আমাদের সমাজে নারীর এসব কাজকে ভিন্ন চোখে দেখা হতো। অনেকেই কটু কথা বলেছেন। কিন্তু আমি দমে যাইনি। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে যা যা করা দরকার সবই করেছি। এখন আমি মোটামুটি সফল। দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছেন আমার শিক্ষার্থীরা। তাঁদের ভালো কিছু করতে দেখে নিজেরই ভালো লাগে।’