বারবার মুখোশ পরে হামলা, শনাক্ত নেই

  • তিন জেলায় এ পর্যন্ত ১৮ গুপ্ত হামলা।

  • মামলা হয়েছে ১০টি; গ্রেপ্তার মাত্র ২।

  • আহত ব্যক্তিরা মামলা করতে চান না।

আবারও গুপ্ত হামলার ঘটনা ঘটল। এবার নওগাঁয় মুখোশধারীরা কুপিয়ে এক বিএনপি নেতাকে হত্যা করেছে। এ নিয়ে গত দুই মাসে জেলার তিন উপজেলায় পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় বিএনপি-জামায়াতের চার নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা শুধু নওগাঁতেই নয়, পাশের জেলা নাটোর ও রাজশাহীতেও হচ্ছে। জানা যায়, নাটোরে এক মাসে ১০টি ও রাজশাহীতে ৩টি ঘটনা ঘটেছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিক থেকে গত শনিবার পর্যন্ত হামলার এসব ঘটনায় ১০টি মামলা হয়েছে। নওগাঁয় একটি মামলায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাটোর ও রাজশাহীতে কোনো গ্রেপ্তার নেই।

মামলা করে আর কী হবে? মামলা করলে পুলিশ ব্যবস্থা তো নেবেই না, উল্টো হামলাকারীদের আরও আক্রোশের শিকার হব। তখন জীবনটাই চলে যেতে পারে।
যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন

হামলার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনাই রাতে ও নির্জন রাস্তায় ঘটেছে। মোটরসাইকেলে ও মাইক্রোবাসে এসে মুখোশধারীরা নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি চালিয়ে গুরুতর জখম করছে।

এই তিন জেলায় গুপ্ত হামলার এমন ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর বেশির ভাগই আর মামলা করতে চান না। পুলিশি হয়রানির ভয়ে মামলা করতে অনাগ্রহ তাঁদের। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব ঘটনা পরস্পর সম্পর্কিত কি না, সেটা তারা খতিয়ে দেখছে।

দল করার কারণেই আমি আক্রোশের শিকার হয়েছি। মামলা করলে আরও হয়রানির শিকার হতে পারি। এ আশঙ্কায় মামলা করিনি।
বরগাছা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান

নওগাঁয় নিহত ১

নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে রানীনগর উপজেলায়। রানীনগরে তিনটি, আত্রাই ও নওগাঁ সদর উপজেলায় একটি করে ঘটনা ঘটেছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এসব হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে। হামলার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ গত শনিবার রাত নয়টার দিকে অটোরিকশায় করে নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকায় বাড়ি ফেরার পথে ইয়াদ আলীর মোড়ে হামলা চালানো হয় পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদের ওপর। মুখোশধারীরা কুপিয়ে গুরুতর জখম করলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছেলে বাদী হয়ে নওগাঁ সদর থানায় মামলা করেছেন। আসামিরা সবাই অজ্ঞাতনামা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

এ বিষয়ে নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান বলেন, হামলার সময় ঘটনাস্থলে একটি বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজে দেখা গেছে, হামলাকারীরা ছয়-সাতজন ছিল। তবে হেলমেট ও মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় কাউকে চেনা যাচ্ছে না।

নওগাঁয় গুপ্ত হামলার প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন আমগ্রাম মোড়ে। উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে পাঁচ-ছয়জন মুখোশধারী তাঁকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে, কুপিয়ে জখম করে। ওই ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি।

জানতে চাইলে যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করে আর কী হবে? মামলা করলে পুলিশ ব্যবস্থা তো নেবেই না, উল্টো হামলাকারীদের আরও আক্রোশের শিকার হব। তখন জীবনটাই চলে যেতে পারে।’

পরের দিন ২৫ সেপ্টেম্বর আত্রাই উপজেলার জগদীশ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও জামায়াতের কর্মী আবুল হোসেনের ওপর হামলা হয়। স্কুল থেকে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে বিকেলে মালিপুকুর বাজার এলাকায় ফাঁকা রাস্তায় মুখোশধারীরা তাঁর ওপর হামলা চালায়। আবুল হোসেন এখনো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবশ্য ওই ঘটনায় আবুল হোসেনের স্ত্রী বাদী হয়ে আত্রাই থানায় মামলা করেছেন।

গত ২৩ অক্টোবর রানীনগর উপজেলার বরগাছা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হানকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। রাত আটটার দিকে উপজেলার মালশন বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তিনিও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হামলার ঘটনায় থানায় এখনো মামলা হয়নি।

চিকিৎসাধীন আবু রায়হান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল করার কারণেই আমি আক্রোশের শিকার হয়েছি। মামলা করলে আরও হয়রানির শিকার হতে পারি। এ আশঙ্কায় মামলা করিনি।’

১২ নভেম্বর রানীনগরের পারইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুর রহমানকে ইউপি কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে জখম করে মুখোশধারীরা। বর্তমানে তিনি ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায়ও থানায় মামলা হয়নি।

দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলার বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব বায়েজিদ হোসেন বলেন, ‘পরপর পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটল। সর্বশেষ শনিবারের হামলার ঘটনায় আমাদের একজন ত্যাগী নেতাকে প্রাণ দিতে হলো। কিন্তু এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হচ্ছে।’

নাটোরে ১০ হামলা

নাটোরে এক মাসে ১০টি গুপ্ত হামলার ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে মাত্র পাঁচটি। এসব মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত জেলার নলডাঙ্গা উপজেলায় ছয়টি, সদর উপজেলায় দুটি, লালপুর উপজেলায় একটি ও সিংড়া উপজেলায় একটি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন বিএনপির, ছয়জন জামায়াতে ইসলামীর ও একজন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

নাটোর সদরের একটি ঘটনা ছাড়া বাকি নয়টি ঘটনা ঘটেছে রাতে। প্রায় সব কটি ঘটনায়ই হামলাকারীরা মুখোশ কিংবা হেলমেট পরে হামলা চালিয়েছে। পাঁচটি ঘটনায় দুর্বৃত্তরা সাদা রঙের মাইক্রোবাস ব্যবহার করেছে বলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এসব হামলার বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, লালপুর ও সিংড়া থানা-পুলিশের ভাষ্য প্রায় এক। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার তদন্ত চলছে। হামলাকারী ও আসামিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে তারা।

রাজশাহীতে দুজন নিহত

গত দেড় মাসে রাজশাহীতে গুপ্ত হামলা হয়েছে তিনটি। এর মধ্যে দুজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। ২৯ অক্টোবর একই রাতে রাজশাহী নগরে এক চিকিৎসক ও একজন পল্লিচিকিৎসক নিহতের ঘটনা ঘটে। নিহত দুজনের জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনটি ঘটনায়ই মুখোশধারীরা মাইক্রোবাসে এসে হামলা করে মাইক্রোবাসেই পালিয়ে যায়। পুলিশ বলছে, গাড়িগুলোর নম্বরবিহীন ছিল। এ জন্য সূত্র ধরে কিছু বের করা যাচ্ছে না। তিনটি মামলাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই তিনটি মামলায় বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।

নিহত দুজন হলেন নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক গোলাম কাজেম আলী (৪২), নগরের কচুয়াতৈল এলাকার পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলী (৪৫)। আর হামলার পর বেঁচে যাওয়া ব্যবসায়ী হলেন কাটাখালী থানা এলাকার শাহীন আলম (৩৪)।

রাত পৌনে ১২টার দিকে চিকিৎসক গোলাম কাজেম আলী বাসায় ফেরার সময় একটি মাইক্রোবাস তাঁর মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে মুখোশধারীরা গোলাম কাজেমের বুকে ছুরিকাঘাত করে। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।

গোলাম কাজেম নিহত হওয়ার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে নগরের রাজপাড়া থানার পুলিশ তদন্ত করে। ১৪ নভেম্বর থেকে পিবিআই মামলাটির তদন্তভার পেয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, রাজপাড়া থানায় মামলার কোনো সূত্র পায়নি। তিনি চেষ্টা করছেন। এখনো এ মামলায় কেউ আটক হয়নি।

২৯ অক্টোবর রাতে খুন হওয়া পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলীকে সিটি বাইপাস এলাকায় কুপিয়ে লাশ ফেলে রেখে যায় মুখোশধারীরা।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বহাল থাকে, সেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনসহ নির্যাতনের শিকার হন। যত দিন এমন ব্যবস্থা বহাল থাকবে, তত দিন এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও প্রতিনিধি, নাটোর]