২৫ বছরের তরুণ মামুন মিয়া ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। চেয়েছিলেন ভালো আয় করে পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাবেন। দরিদ্র পরিবারের স্বপ্ন জয় করতে চাকরি নিয়ে ২২ আগস্ট মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর।
১৮ জুলাই দিবাগত রাত দুইটার দিকে রামপুরা ওয়াপদা রোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মামুন। বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে নিয়ে যান। পরদিন শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মামুন শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের চরচিকন্দি গ্রামের আবদুল গনি মাদবরের ছেলে।
গ্রামবাসী জানান, চরচিকন্দি গ্রামের গনি মাদবর ও হেনা বেগম দম্পতির চার ছেলে। কৃষিকাজ করে পরিবারটি চলে। ছয় মাস আগে বড় ছেলে নুরুজ্জামান শ্রমিকের কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যান। দুই ছেলে কালু ও রুবেল মাদবর গাজীপুরে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ছোট ছেলে মামুন মিয়া পড়ালেখা করতেন। স্থানীয় শৌলপাড়া মনর খান উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও শরীয়তপুর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। ঢাকার রামপুরার ওয়াপদা রোড এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে ও পরিবারের অভাব দূর করতে দেশের বাইরে চাকরি খুঁজছিলেন মামুন। মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজের একটি হোটেলে চাকরিও পেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার ভিসা পেয়েছিলেন। আগামী ২২ আগস্ট তাঁর যাওয়ার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে গুলিতে নিহত হন তিনি।
মামুনের বড় ভাই রুবেল মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামুন আমাদের পরিবারের অনেক আদরের ছিল। আমরা সবাই মিলে ওকে পড়ালেখা করিয়েছি। ওর ওপর ভরসা করেই আমরা বেঁচে ছিলাম। সে বিদেশের একটি হোটেলে চাকরি পেয়েছিল। সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৯ জুলাই শুক্রবার গ্রামে এসে বাবাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই শুক্রবার ওর নিথর দেহ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে।’
সদর উপজেলার ডোমসার-গঙ্গনগর সড়কের গ্রামচিকন্দি থেকে এক কিলোমিটার মেঠোপথ দিয়ে এগোলেই চরচিকন্দি গ্রাম। মামুনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বসতঘরের সামনে মামুনকে দাফন করা হয়েছে। কবরের সামনে স্বজনদের ভিড়। টিনের তৈরি ঘরের মেঝেতে বসে কাঁদছেন মা হেনা বেগম। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
হেনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটি কী ক্ষতি করেছিল? কেন ওকে গুলি করে মারল? এর বিচার আমি কার কাছে চাইব? মায়ের কোলে সন্তানের লাশ কত ভারী, তা কেউ বুঝবে না। বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করে বলল, পরের দিন বাড়ি আসবে। সে যে প্রাণহীন হয়ে আসবে, কে জানত?’
মামুনের বাবা আবদুল গনি বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেটি রাত জেগে অনলাইনে কাজ করত। ওই দিন বাসায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ছিল না। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খেতে বাসার বাইরে এসেছিল। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়। আমি এমন অভাগা বাবা, সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। ছেলেকে পড়ালেখা করাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সে আমাকে বলত বাবা, চিন্তা কোরো না। আমি বিদেশ যাচ্ছি, আমাদের কোনো অভাব থাকবে না। এখন আমার বুকের মানিকের অভাব কে পূরণ করব?’
শৌলপাড়া মনর খান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোতালেব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামুন মেধাবী ও বিশ্বস্ত ছাত্র ছিল। ওর এমন মৃত্যু মানতে পারছি না। কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তখন বলেছিল ২২ আগস্ট বেলিজ যাচ্ছে।’
শৌলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খান বলেন, ‘মামুনের মৃত্যু দুঃখজনক। ওর এমন মৃত্যু আমরা মানতে পারছি না। দরিদ্র পরিবারের সম্পদ ও স্বপ্ন ছিল সে। মামুন ও তার পরিবার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। আমরা ওর পরিবারের পাশে থাকব।’