গত এক বছরে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে ১০ লাখের মতো মুরগির ডিম আমদানি করেছে। অথচ এ সময়ে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৩৩ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় সরবরাহ সংকটের মধ্যে ডিমের বাজার চড়া হওয়ার পর কয়েক দফায় ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও ব্যবসায়ীরা এখন আর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ডিম আমদানিতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা মানতে তাঁরা বিপত্তিতে পড়ছেন বলে তাঁদের অভিযোগ।
দেশে চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি থাকায় প্রায়ই ডিমের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। গত মাসে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায় উঠেছিল। ভারতে ডিমের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম হওয়ায় ভালো মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা কেন তা আমদানি করছেন না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এর কারণ খুঁজতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হয় কয়েকজন আমদানিকারকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ডিম আমদানিতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয় পক্ষকেই কিছু কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব শর্ত পূরণ করে ভারতের রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশে ডিম পাঠানোকে ‘ঝামেলা’ মনে করছেন। এ কারণে তাঁরাও রপ্তানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা এখনো জানেন না।
ভারত থেকে ডিম আমদানির ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হচ্ছে—ডিম তিন ধরনের রোগ থেকে মুক্ত কি না, তা নিশ্চিত করতে কলকাতার অ্যানিমেল কোয়ারেন্টাইন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন সার্ভিস থেকে সনদ নিতে হবে। ওই সনদ থাকলেই কেবল বেনাপোল বন্দরে ডিমের চালান খালাস করা হয়। এ ছাড়া গত ২২ অক্টোবর নতুন আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়েছে, এখন থেকে আইএসও সনদপ্রাপ্ত বাংলাদেশি ল্যাব থেকে নমুনা পরীক্ষা করে মাইক্রো প্লাজমা, এভিয়েন ইনফ্লুঞ্জাসহ তিনটি রোগের বিষয়ে সনদ নিতে হবে। নতুন এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আমদানিকারকেরা ভোগান্তিতে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কলকাতার সনদের ভিত্তিতে ঢাকার হাইড্রোল্যান্ড সল্যুশান নামের একটি প্রতিষ্ঠান ডিমের তিনটি চালান আমদানি করেছিল। কিন্তু অক্টোবর মাসে নতুন শর্ত যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারির পর এই প্রতিষ্ঠানও ডিম আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, ডিম আসার পর নমুনা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে কোয়ারেন্টিন সনদ নিয়ে তা আবার বন্দরে পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগবে। অন্যদিকে স্থলবন্দরে অপেক্ষায় থাকা ট্রাকের পেছনে প্রতিদিন পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা বাড়তি মাশুল গুনতে হবে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে।
এ বিষয়ে হাইড্রোল্যান্ড সল্যুশানের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএসও সার্টিফায়েড ল্যাব বেনাপোল বন্দর বা যশোর-খুলনাঞ্চলে নেই। ওই ল্যাব আছে ঢাকার সাভারে। নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে তা বন্দরে পাঠাতে যে সময় লাগবে, তাতে ডিম নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। লোকসানের ঝুঁকি বেশি থাকার কারণে ডিম আমদানি আপাতত বন্ধ রেখেছি।’
জানতে চাইলে বেনাপোল বন্দরের কোয়ারেন্টিন স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও শার্শা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তপু কুমার সাহা বলেন, ‘ডিম আমদানি সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, ডিম আমদানির ক্ষেত্রে তিনটি রোগের পরীক্ষা আইএসও সার্টিফায়েড ল্যাব থেকে করাতে হবে। ঢাকা সাভারের সরকারি কিউসি ল্যাব অথবা আইএসও সার্টিফায়েড অন্য কোনো বেসরকারি ল্যাব থেকেও করা যাবে। নমুনা পরীক্ষা প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত চার দিন লেগে যাবে।’
আমদানিকারকেরা কেন ডিম আমদানি করছেন না, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুব্রত দে প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিকারকদের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তবে ডিম আমদানিতে উৎসাহ দিতে ইতিমধ্যে ৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তারপরও কী কারণে আমদানিকারকেরা আগ্রহী হচ্ছেন না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
সরকারের নতুন প্রজ্ঞাপন বিষয়ে জানতে চাইলে সুব্রত দে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ বিভাগের ওই প্রজ্ঞাপন এখনো আমাদের নজরে আসেনি। প্রজ্ঞাপনটি দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২৫ কোটি মুরগির ডিম আমদানির অনুমোদন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রনালয়। ডিম দেশে আনার জন্য সময় দেওয়া হয় দুই মাস। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান ডিম আমদানি করেনি। আবার চলতি বছরের অক্টোবর মাসে দুই দফায় ১৯টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নতুন করে সাড়ে ৮ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ডিম আমদানির সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
গত বছর অনুমোদন নেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিনবার সময় বাড়িয়ে ডিম আমদানির চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে শুধু হাইড্রোল্যান্ড সল্যুশান ১০ লাখের মতো ডিম আমদানি করেছে। যদিও তাদের অনুকূলে ৫০ লাখ ডিম আমদানির অনুমোদন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি তো যৎসামান্য হলেও আমদানি করেছি। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তো আমদানির সাহসই দেখায়নি।’
সিলেটের মৌলভীবাজারের পিংকি ট্রেডার্সের অনুকূলে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে এক কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। সময় পেরিয়ে গেলেও এই প্রতিষ্ঠান একটি ডিমও আমদানি করেনি।
প্রতিষ্ঠানের মালিক সলিল শেখর দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে ভারত থেকে ২৫ হাজার ডিম আমদানির জন্য টাকা টিটি করেছিলাম। কিন্তু বার্ড ফ্লুসহ কয়েকটি রোগের বিষয়ে সনদ দেওয়ার যে শর্ত ছিল, তা ভারতের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পূরণ করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিড়ম্বনা হয়েছে। এ জন্য আর ডিম আমদানি করা যায়নি।’
চলতি বছরের জুলাই মাসে ৫০ হাজার ডিম আমদানির অনুমতি পেয়েছিল ঢাকার এমটিএস ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মামুন অর রশীদ বলেন, ডিম আমদানির জন্য সরকার যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তা পূরণ করে আমদানি করা হলে কোনো মুনাফা করা যাবে না। সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিলেও ব্যবস্থা আমদানিবান্ধব নয়। বন্দর, কাস্টম ও কোয়ারেন্টিন বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।