লিজা আক্তার ও সুমন মিয়ার বিয়ে হয় প্রায় ১৬ বছর আগে। দীর্ঘদিন তাঁদের সন্তান হয়নি। বিদেশে চিকিৎসার পর গত বছর অন্তঃসত্ত্বা হন লিজা। গত চার মাস তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাঁর যমজ বাচ্চা হবে; দ্রুতই করা হবে অস্ত্রোপচার। কিন্তু অনাগত সন্তানকে দেখে যেতে পারলেন না সুমন মিয়া।
নরসিংদী রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী সুমন মিয়া হামলায় নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলার পাড়াতলী ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন তিনি। বিকেলে রায়পুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমন মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত সুমন মিয়া উপজেলার চরসুবুদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিনের ছেলে। তাঁদের বাড়ি চরসুবুদ্দি ইউনিয়নের মহিষবেড় গ্রামে। সুমন মিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তালা প্রতীকে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তিনি অ্যাগ্রো ফার্ম, পোলট্রি ফিড, মাছের খামারের ব্যবসা করতেন। নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি।
ময়নাতদন্ত শেষে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে সুমন মিয়ার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। এদিকে প্রার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় উপজেলা পরিষদের সব পদের নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
আজ দুপুর ১২টার দিকে মহিষবেড় গ্রামে গিয়ে দেখা যায় নাসির উদ্দিনের বাড়িতে অসংখ্য মানুষ। তাঁরা শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আঙিনায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন পুরুষেরা। ঘরের ভেতর নারীরা মাদুরের ওপর বসে কান্নাকাটি করছেন। নাসির উদ্দীন একবার বাইরে এসে চেয়ারে বসছেন। আবার তিনি বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছেন। কেউ কিছু বলতে এলেই শুধু ছেলের জন্য দোয়া চাইছেন। সুমনের মা গতকাল রাতে হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঘরে তাঁর পাশে বসে আছেন স্বজন ও প্রতিবেশী নারীরা।
নিহত সুমন মিয়ার বাবা নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, সুমনের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রসবের অপেক্ষায় থাকা সুমনের স্ত্রী লিজাকে এখনো ঘটনা জানানো হয়নি। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের খবর জানানোর আগেই তাঁর প্রসব করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দাফন শেষে মামলা করার জন্য থানায় যাবেন তিনি।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘দুটি প্যানেল’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের অঘোষিত ‘দুটি প্যানেল’ তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষে আছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী লায়লা কানিজ ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া। অন্য পক্ষে চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌস কামাল ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান (রুবেল)। দুই পক্ষের প্রার্থীরা দল বেঁধে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচার চালাচ্ছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও স্থানীয় অন্তত ২০ জনের সঙ্গে আজ বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী সুমন মিয়া ও আবিদ হাসান দুজনই সমর্থকদের নিয়ে বুধবার চরাঞ্চল পাড়াতলীতে জনসংযোগ করছিলেন। চেয়ারম্যান প্রার্থী লায়লা কানিজের সঙ্গে যৌথভাবে প্রচারণায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন সুমন মিয়া। পথে মীরেরকান্দি এলাকায় বেলা দেড়টায় ১৫-২০টি মোটরসাইকেলে করে আবিদ হাসানের একদল কর্মী সুমন মিয়ার দুটি গাড়ির (প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস) পথরোধ করে ভাঙচুর শুরু করেন। তখন সুমনের দেহরক্ষী লাইসেন্স করা শটগান বের করে ফাঁকা গুলি করেন। এ সময় আবিদ হাসানের আরও কর্মী–সমর্থক ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁরা সুমন মিয়া ও তাঁর কর্মীদের মারধর করেন। গুরুতর আহত সুমন মিয়া দৌড়ে জমির আল ধরে পালিয়ে যান এবং প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঁশগাড়ীর পুলিশ ক্যাম্পে পৌঁছান বেলা সাড়ে তিনটায়।
ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা বিষয়টি রায়পুরা থানার ওসিকে জানান। ওসি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু খবর পেয়ে আবিদ হাসানের কর্মী-সমর্থকেরা হাসপাতালের গেটে মিছিল নিয়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখেন। পরে ওসি সাফায়েত হোসেন সেখানে গিয়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাঁশগাড়ীর উদ্দেশে রওনা হন। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বাঁশগাড়ী ফাঁড়ি থেকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে সুমন মিয়াকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খান নুরউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর জানান, হামলা হওয়ার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর সুমন মিয়াকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তাঁর মাথায়-নাকে-মুখে আঘাত করা হয়েছিল। নাক দিয়ে রক্ত ও তাঁর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে এটুকু বলা যায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।
‘এই হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত’
হামলার সময় সুমন মিয়ার সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই কর্মী টিটু মিয়া ও মাসুম মিয়া। ওই দুজন জানান, ওই সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান বিভিন্ন কথা বলে সুমন ভাইকে উসকানি দিচ্ছিলেন। তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা গাড়ি ভাঙচুর করতে গেলে সুমনের দেহরক্ষী লুৎফর গাড়ির ভেতর থেকে শটগান বের করে ফাঁকা গুলি করেন। এরপরই আবিদের শত শত কর্মী-সমর্থকেরা সুমনসহ তাঁদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করেন। সুমনের মাথায়-নাকে-মুখে আঘাত করেন। পরে তাঁরা দৌড়ে পালিয়ে যান।
টিটু মিয়া ও মাসুম মিয়া অভিযোগ করেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌস কামাল ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান পরিকল্পনা করে সুমন ভাইকে হত্যা করেছেন। সুমন ভাই মাঠে থাকলে তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তাই এই হত্যাকাণ্ড।’
এ বিষয়ে জানতে আজ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসানের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
রায়পুরা থানা ওসি সাফায়েত হোসেন জানান, সুমন মিয়া নিহতের ঘটনায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি। তবে ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের ১৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।