বন্য প্রাণী রক্ষায় নানা আইন থাকলেও প্রকাশ্যে পশুপাখিসহ নানা প্রাণী বিক্রি হয়। নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজারে গতকাল বিকেল চারটায়
বন্য প্রাণী রক্ষায় নানা আইন থাকলেও প্রকাশ্যে পশুপাখিসহ নানা প্রাণী বিক্রি হয়। নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজারে গতকাল বিকেল চারটায়

বন্য প্রাণী পাচারের ‘ট্রানজিট’ চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম সিটি গেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুটি বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় মো. আতুয়ার নামের এক ব্যক্তিকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তিনি মূলত বাহক। বান্দরবানের আলীকদম থেকে অন্য একজন লজ্জাবতী বানর দুটি বুঝিয়ে দেন তাঁকে। ওই বানর দুটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার কথা তাঁর।

তিন পার্বত্য জেলা থেকে ধরা বন্য প্রাণী এভাবে চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বন বিভাগ বলছে, চট্টগ্রাম মূল পাচারস্থল না হলেও বন্য প্রাণী পাচারের ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট এড়াতে পাহাড়ের ভেতরে থাকা দুর্গম সড়কগুলো ব্যবহার করেন পাচারকারীরা। বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে সারা দেশে মোট ৪৩ মাসে ১৭ হাজার ৮৭৭টি বন্য প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর এক-তৃতীয়াংশের বেশি উদ্ধার হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ‘এক্সপ্লোরিং মার্কেট-বেজড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রেড ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, দেশের মোট ১৩ জেলায় প্রকাশ্যে বন্য প্রাণী বেচাকেনা চলে। এসব জেলা থেকে বন্য প্রাণী ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আনা হয়। ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে ও চট্টগ্রাম সমুদ্রপথে প্রাণী পাচার করা হয় মোটা টাকার বিনিময়ে।

বন বিভাগ সারা দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব প্রাণী উদ্ধার করেছে তার মধ্যে রয়েছে শুশুক, বনরুই, লজ্জাবতী বানর, সুন্ধি কাছিম, হরিণ, হনুমান, মেছো বিড়াল, গন্ধগোকুল, ভালুক, অজগর, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ মোট ৬৫ প্রজাতির প্রাণী। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়েই এসব পাচার করছিলেন পাচারকারীরা।

‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ চট্টগ্রাম

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটিতে যে ১৩টি জেলার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি (রাঙামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান) চট্টগ্রাম বিভাগে। গত বছরের মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় দুটি ভালুকছানা আটক করে স্থানীয় পুলিশ।

আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভালুকের ছানা দুটি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে ভারতে পাচার করা হয়েছিল। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কুমিল্লায় মহাবিপন্ন প্রজাতির একটি উল্লুক উদ্ধার করা হয়। এটিও পাচার হচ্ছিল পার্বত্য অঞ্চল থেকে। আর এগুলো নেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম নগরে হয়েই।

গত বছরের আগস্ট মাস থেকে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৭২টির বেশি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। আর এসব অভিযানে ৫১৬টি প্রাণী উদ্ধার করা হয়। একই সময়ে সারা দেশে উদ্ধার হয়েছিল ১ হাজার ৪২৮টি পাখি ও বন্য প্রাণী; অর্থাৎ মোট উদ্ধারের প্রায় ৩৬ শতাংশ উদ্ধার হয়েছে চট্টগ্রামে।

চট্টগ্রামের দেওয়ান হাট ও রিয়াজউদ্দিন বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি করা হয় শালিক, ঘুঘু, টিয়া, ময়নাসহ বিভিন্ন পাখি। যেসব পাখি আইন অনুযায়ী ধরা ও বিক্রি অপরাধ। বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে এসব পাখি উদ্ধার করে মুক্ত করা হলেও কিছুদিন যেতেই আবারও বিক্রি শুরু করেন বিক্রেতারা।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (চট্টগ্রাম) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রাণীগুলো সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসেন পাচারকারীরা। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠে পড়েন তাঁরা।

পার্বত্য অঞ্চলের চেকপোস্ট ফাঁকি দিতে তাঁরা জঙ্গলের ভেতরের পথগুলো দিয়ে চলাচল করেন।

ছাড়া পেয়ে আবার পাচার চক্রে

দেশে বন্য প্রাণীর সুরক্ষার জন্য ২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন করা হয়। আইনের সংশোধিত তফসিলে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ ইত্যাদিকে রক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে।

এসব প্রাণী হত্যা, শিকার ও পাচার করলে শাস্তির কথাও উল্লেখ আছে আইনে। তবে আইন থাকলেও আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আবারও বন্য প্রাণী পাচারে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম বন বিভাগ বলছে, চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় উদ্ধার অভিযানে দেখা যায়, একই ব্যক্তিরাই এসব অপরাধে বারবার জড়াচ্ছেন।  

গত বছরের ২৪ মে ৪টি রাজধনেশসহ মো. সেলিম নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার পুলিশ। সে সময় তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে জামিনে বেরিয়ে একই বছর নভেম্বর মাসে আবারও বন্য প্রাণীর পাচারের সময় ধরা পড়েন সেলিম। চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে পাঁচটি মুখপোড়া হনুমানসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

দেশে বর্তমানে বন্য প্রাণী পাচার রোধে পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, র‍্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থাও (ইন্টারপোল) নজরদারিতে রেখেছে বাংলাদেশের বনাঞ্চলগুলো।

হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১ হাজার ৬০০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ৩৯০টি প্রজাতিই বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে। এই প্রজাতিগুলোকে আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে।

পাচার, শিকার ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে প্রকৃতিতে বন্য প্রাণীর সংখ্যা কমছে। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী। ওয়াইল্ড টিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সারা বিশ্বে বন্য প্রাণীর সংখ্যা কমছে। একটি বিপন্ন প্রাণী পাচার করতে করতে একসময় তা মহাবিপন্ন হবে, এরপর বিলুপ্ত হয়ে যাবে চিরতরে। তাই পাচার বন্ধ করা প্রয়োজন।