গত দুই বছরে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ৩০ বার সংঘর্ষ হয়েছে। নিহত হয়েছেন একজন, আহত হয়েছেন অনেকে।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরা ইউনিয়নের সোনাতলা ও পুঁটিপাড়া গ্রামে গত দুই বছরে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ৩০ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় নিহত হয়েছেন একজন, আহত হয়েছেন অনেকে। অসংখ্য বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। অনেক পরিবারের সদস্য এখনো বাড়িছাড়া। সর্বশেষ ১৭–১৯ ডিসেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
গত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনসহ এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানের লোকজনের দ্বন্দ্বে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন।
নাগডেমরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের বাড়ি সোনাতলা গ্রামে। একই গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর রশীদ। এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউপি নির্বাচনের সময় এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। তখন চেয়ারম্যান পদে দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন পান তৎকালীন চেয়ারম্যান হারুন-অর রশীদ। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হন হাফিজুর রহমান।
ওই ইউপি নির্বাচনের সময় দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের পর তা আরও বেড়ে যায়। দুই পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে সোনাতলা ও এর পার্শ্ববর্তী পুঁটিপাড়া গ্রামে। গত বছরের ৪ মে রাতে পুঁটিপাড়া গ্রামের সেচ খালের পাশে হারুন-অর রশীদের আত্মীয় বলে পরিচিত আবদুল মতিন (৫০) নামের এক কৃষক খুন হন। এ ঘটনায় হারুন-অর রশীদ বাদী হয়ে চেয়ারম্যান হাফিজুরসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে ঘটনার পরদিন ৫ মে পুলিশ হাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় আড়াই মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিহত আবদুল মতিনের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা চলতি বছরের ২৯ জুলাই ও ২০ আগস্ট দুটি সংবাদ সম্মেলন করেন। অভিযোগ রয়েছে, দুই পক্ষের চাপে পড়েই তাঁরা সংবাদ সম্মেলনে আসেন। এতে প্রথমবার, হারুন-অর রশীদ ও তাঁর লোকজন এবং দ্বিতীয়বার হাফিজুর ও তাঁর লোকজন হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। গত সোমবার গিয়ে জানা যায়, দুই পক্ষের চাপ থেকে বাঁচতে নিহত মতিনের পরিবারের লোকজন বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছেন।
এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা, হামলা, লুটপাট ও সংঘর্ষ বাড়তেই থাকে। চলতি বছরের ৪ আগস্ট প্রতিপক্ষের লোকজন হারুন-অর রশীদকে হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেন। এরপর দুই পক্ষের সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়। এক পর্যায়ে হারুন-অর রশীদের লোকজন গোটা গ্রাম দখল করে নেন। এতে হাফিজুরের পক্ষের অন্তত এক হাজার পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে নারী-শিশুরা বাড়ি ফিরে এলেও পুরুষেরা প্রায় পাঁচ মাস বাইরেই ছিলেন। অবশেষে গত শনিবার রাতে বাড়ি ছেড়ে থাকা দেড় থেকে দুই হাজার লোক একসঙ্গে বাড়ি ফেরেন।
পরদিন রোববার আবার দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। তিন দিনে দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। অন্তত ২৫টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
সোমবার সোনাতলা গ্রামের মধ্যপাড়ায় গিয়ে ঘরবাড়িতে হামলা ও লুটপাটের চিহ্ন চোখে পড়ে। এ সময় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি জানান, হারুন-অর রশীদের লোকজনের ভয়ে প্রায় পাঁচ মাস তাঁরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। এখন বাড়ি ফিরে দেখেন, ঘরে কিছুই নেই। জমির ফসলসহ বাড়ির সবকিছু লুট হয়ে গেছে।
হাফিজুরের পক্ষের মনজুরুল হক বলেন, ‘বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট কইর্যা আমাকে নিঃস্ব কইর্যা দিছে। আমি এখন কী কইর্যা আবার ঘর দেব।’
অন্যদিকে সোনাতলা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় অবস্থিত হারুন-অর রশীদের সমর্থকদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও বেশ কয়েকটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
হারুন-অর রশীদের পক্ষের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন ঘর দিছিল্যাম। সোমবার সকালে তিন-চার শ লোক আইস্যা ঘরখান ভাইঙ্যা দিয়্যা গেল। ঘরের খাট থেকে শুরু কইর্যা প্লেট পর্যন্ত সবকিছুই ভাইঙ্যা দিয়্যা গেছে। আমি সর্বস্বান্ত হয়া গেলাম।’
এই পরিস্থিতির জন্য পরস্পরকে দায়ী করেছেন হারুন-অর রশীদ ও হাফিজুর রহমান। হারুন-অর রশীদ বলেন, ‘এলাকায় একক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য হাফিজুর ও তাঁর লোকজন বিনা উসকানিতে আমার ও আমার লোকজনের ওপর হামলা, বাড়িঘরে লুটপাট চালাচ্ছে। সে (হাফিজুর) আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে একাধিকবার চেষ্টা করেছে। মতিন হত্যার সঙ্গে সে–ই জড়িত। অথচ ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল।’
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার লোকজনকে দীর্ঘদিন সে (হারুন-অর রশীদ) এলাকাছাড়া করে রেখেছিল। কিছু লোক বাড়ি ফিরলেও এখনো অনেকেই ফিরতে পারেনি। নির্বাচনে আমার কাছে পরাজিত হওয়ার প্রতিহিংসা থেকে সে একের পর এক হামলা ও লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে।’
সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুই পক্ষকে নিয়ে আমরা সমঝোতার নানা উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু তাদের কারোরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই। তারা একের পর এক সংঘর্ষ, হামলা, মামলায় জড়াচ্ছে। এরপরও আমরা বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছি।’