কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে আজ সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ছয় দিনে ১৫৪টি পরিবারের ৪৭৫ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করেছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। আগামীকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত আরও কিছু রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে প্রতিনিধিদলটির মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
১৫ মার্চ টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকা ৪৭৫ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণে বাংলাদেশ আসে ২২ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আজ সোমবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও তথ্য যাচাই শুরু করেন। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ২৬টি পরিবারের ৮৬ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
গত রোববার ২৬টি পরিবারের ৭৫ জন, গত শনিবার ২৬টি পরিবারের ৬৯ জন, গত শুক্রবার ২৮টি পরিবারের ৭৪ জন, গত বৃহস্পতিবার ২৩টি পরিবারের ৭৮ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং তথ্য যাচাই করা হয়। সব মিলিয়ে গত ছয় দিনে তথ্য যাচাই হয়েছে ১৫৪টি পরিবারের ৪৭৫ জন রোহিঙ্গার।
দেখা গেছে, সকালে টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে গাড়িতে করে রোহিঙ্গাদের স্থলবন্দরের ভেতরে তৈরি প্যান্ডেলে আনা হয়েছে। সেখান থেকে রোহিঙ্গারা প্রতিনিধিদলের সামনে বসে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পুনরায় আশ্রয়শিবিরে ফিরে যাচ্ছেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ের পাশাপাশি কাগজে স্বাক্ষর নিচ্ছেন। ছবিও তুলে রাখছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
দুপুরে সাক্ষাৎকার প্রদান শেষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবির থেকে আসা একজন রোহিঙ্গা প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সদস্যরা প্রায় সব রোহিঙ্গার কাছে একই রকম প্রশ্নের উত্তর নিতে চেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে সাক্ষাৎপ্রার্থীর বাড়ি রাখাইন রাজ্যে কোন গ্রামে ছিল, সেখানকার ইউপি চেয়ারম্যান (ওক্কাট্টা) কে ছিলেন, সমাজের সরদার কে ছিলেন, সেখানে থাকতে কতজন সন্তান ছিল, বাংলাদেশে আসার পর কতজন ছেলেমেয়ে জন্ম নিয়েছে, মিয়ানমারে ফিরতে রাজি কি না?
তবে বহু রোহিঙ্গা মিয়ানমার প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে এসেছেন, নাগরিকত্ব না পেলে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবেন না। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।
সাক্ষাৎকারটি লোকদেখানো মনে হয়েছে দাবি করে রোহিঙ্গা সলিম উল্লাহ বলেন, শিগগিরই যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তেমন আলামত দেখা যাচ্ছে না। কারণ, নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের যেসব গ্রাম থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর আট লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেসব গ্রামের কোনো চিহ্নই এখন নেই। গ্রামগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে সেনাছাউনি এবং সামরিক ব্যারাক। কিছু গ্রামে মগ সম্প্রদায়ের বসতি গড়া হয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ঘরবাড়িতে পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো সেখানকার (রাখাইনের) আশ্রয়শিবিরে বন্দিজীবন কাটানোর ইচ্ছা কোনো রোহিঙ্গার নেই।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয় বলে মনে করে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে এ-ও বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনায় তারা জড়িত নয়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, গত ছয় দিনে টেকনাফে চার শতাধিক রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ করেছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। আগামীকাল মঙ্গলবার আরও কিছু রোহিঙ্গার তথ্য যাচাইয়ের কাজ শেষ করে দলটি নিজ দেশে ফিরে যাবে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে দলটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্য থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফে এসেছে ওই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎ এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য। আশ্রয়শিবিরে থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে, মিয়ানমার প্রতিনিধিদল সেসব শিশুর তথ্যও যাচাই করছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের মুখে। কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।