যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। গতকাল শুক্রবার দুপুরে
যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। গতকাল শুক্রবার দুপুরে

পৌনে ৩০০ বছর ধরে ভৈরব নদের তীরে বসছে চৈত্রসংক্রান্তির যে মেলা

যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অভয়নগরের রাজঘাট এলাকা। রাজঘাটের উত্তর পাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। নদের উত্তর পাশে অভয়নগর গ্রাম। গ্রামের ভৈরব নদের তীরে গাছগাছালির মধ্যে এক আঙিনায় সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ১১টি মন্দির।

প্রতিবছরের মতো এবারও এসব মন্দির ঘিরে বসেছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মেলায় দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের উপকরণ নিয়ে হাজির হন অর্ধশত বিক্রেতা। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

গতকাল দুপুরে মেলায় গিয়ে দেখা গেল, নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ১১টি মন্দির। পূর্ব-পশ্চিমে প্রতি সারিতে ৪টি করে ৮টি এবং সদর তোরণ ও তার দুই পাশে দুটি—মোট ১১টি মন্দির। মন্দিরগুলোর চারপাশ ঘিরে বসেছে বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী দোকান। মন্দির প্রাঙ্গণে তিলধারণের জায়গা নেই। ভক্ত-পুণ্যার্থীর সমাগম, ঢাকঢোল-কাঁসরের বাজনা, মেলার কোলাহল এক উৎসবমুখর আবহের সৃষ্টি করেছে।

মন্দিরগুলোর চারপাশ ঘিরে অস্থায়ী দোকানে মিষ্টিসহ নানা পণ্য নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। গতকাল যশোরের অভয়নগরে

ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ‘চাঁচড়া রাজবংশ’ নামে একটি অধ্যায় আছে। ওই অধ্যায়ে বর্ণনা অনুযায়ী, চাঁচড়া ছিল যশোর রাজ্যের অন্তর্গত। ১৭৪৫ থেকে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যশোরের চাঁচড়ার রাজা ছিলেন নীলকণ্ঠ রায়। তিনি ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। তখন থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্রসংক্রান্তির পূজায় মেলা বসছে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, ওই হিসাব অনুযায়ী চৈত্রসংক্রান্তির এই মেলা বসছে প্রায় ২৭৫ বছর ধরে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে মেলার আয়োজন বন্ধ ছিল। তবে চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিকূলতা কাটিয়ে ২০২১ সাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে এবং বর্ণিল আয়োজনে আবার শুরু হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।

সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলায় অবস্থান করে দেখা যায়, চৈত্রের খরতাপের মধ্যে মেলায় বিভিন্ন বয়সী মানুষ আসছেন। মেলায় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। মেলায় খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা ধরনের জিনিস বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মেলায় রয়েছে মিষ্টি, জিলাপি, চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসাসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন।

ভৈরব তীরের মন্দিরে ভক্তদের ভিড়। গতকাল যশোরের অভয়নগরে

মেলায় খুলনার ফুলতলা থেকে কুলফি মালাই নিয়ে এসেছেন নূরুল ইসলাম (৫৫)। তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে মেলায় কুলফি মালাই নিয়ে আসছি। আজ বেশ রোদ পড়েছে। ভালোই কুলফি মালাই বিক্রি হচ্ছে।’

মেলায় পাঁপড় বিক্রি করছেন অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের হারুন শেখ (৪৩)। তিনি বলেন, গরমে পাঁপড় একটু কম বিক্রি হচ্ছে। তারপরও যে পরিমাণ পাঁপড় বিক্রি হচ্ছে, তা ভালোই বলতে হবে।

মেয়েকে নিয়ে মেলায় এসেছেন ভাটপাড়া গ্রামের গৃহবধূ কবিতা নন্দী। তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড রোদ। তারপরও মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। মন্দিরের ভেতরে রাখা শিবের মাথায় ডাবের জল ঢেলেছি। গাছ থেকে ভাঙা খেজুর ধরে খেয়েছি। মেলা থেকে পাঁপড় কিনেছি।’

আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসেন ঐতিহ্যবাহী এই মেলায়

অভয়নগর চৈত্রসংক্রান্তি পূজা কমিটির সভাপতি শিবায়ন দাস বলেন, এবার আবহাওয়া ভালো ছিল। তবে রোদ ছিল প্রখর। দুপুর থেকে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে। মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল।

একাদশ শিবমন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মিলন কুমার পাল বলেন, মন্দিরের বয়স প্রায় ২৭৫ বছর। শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্রসংক্রান্তির পূজাতে মেলা হয়ে আসছে। আশপাশের কয়েক গ্রামের সব ধর্মের মানুষ আসেন মেলায়। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এলাকার সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।