নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে বিস্ফোরণে ধসে পড়া সেই শত বছরের পুরোনো দোতলা ভবনের সামনের সড়কে মাটি খুঁড়ে গ্যাস সরবরাহের মেইন পাইপলাইনে দুটি লিকেজ পেয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। গতকাল শনিবার রাত আটটার দিকে লিকেজ দুটি শনাক্তের পর মেরামত শেষে বিস্ফোরণের ৯ দিন পর আর কে দাস রোডসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ সচল করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ব্যবসায়ীরা জানান, গতকাল দুপুরে নিতাইগঞ্জের আর কে দাস রোডের ভবনের সামনের সড়কে তিতাসের পাঁচ শ্রমিক মাটি খোঁড়া শুরু করেন। তাঁরা সড়কের প্রায় সাত ফুট মাটি খুঁড়ে তিতাসের এক ইঞ্চি ব্যাসের মেইন পাইপলাইনে দুটি লিকেজ দেখতে পান। পরে পাইপলাইনের লিকেজ রাত আটটার দিকে মেরামত করেন।
লিকেজ মেরামতকাজ শেষে নিতাইগঞ্জের আর কে দাস রোড, বি দাস রোড, ওল্ড ব্যাংক রোড, নিমতলী, বংশাল, মণ্ডলপাড়াসহ আশপাশের এলাকার গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু করা হয়। আট দিন পর গ্যাস সরবরাহ চালু হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।
তিতাস গ্যাসের মেইন সরবরাহ পাইপলাইনে লিকেজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নিতাইগঞ্জ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শংকর সাহা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিতাসের লোকজন মাটি খুঁড়ে মেইন পাইপলাইনে দুটি লিকেজ পেয়েছেন। সেটি মেরামত শেষে রাত আটটার দিকে গ্যাস সরবরাহ চালু করে দিয়েছেন। তিতাসের লোকজন ওই বাড়ির গ্যাসের রাইজার খুলে নিয়েছেন ও গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, লিকেজ মেরামতে ভবনমালিক ও তিতাসের লোকজন আগে যদি উদ্যোগ নিতেন, তাহলে দুর্ঘটনায় এই তিনজন মানুষের মৃত্যু হতো না। তাঁদের গাফিলতির কারণে এসব মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ভবনটির সামনের সড়কে বুদ্বুদ করে গ্যাস বের হওয়ায় জায়গা খুঁড়ে মূল পাইপলাইনের দুটি জায়গায় সন্দেহজনক মরিচা ধরা দেখতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাসের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ। তবে ওই জায়গা দিয়ে বের হওয়া গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ নয় বলে মনে করেন তিনি। তাঁর দাবি সড়কের মেইন পাইপলাইনের যেখানে সন্দেহভাজন লিকেজ পাওয়া গেছে, সেখান দিয়ে গ্যাস বের হয়ে ভবনের ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, গ্যাসের ধর্মই হচ্ছে, ওপরের দিকে উঠে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাবে।
তিতাসের ওই কর্মকর্তা জানান, ওই ভবনের নিচ দিয়ে গ্যাসের কোনো পাইপলাইন ছিল না। ভবনের পেছনের অংশে রাইজার ছিল, সেখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে দোতলায় একটি চুলায় গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন ছিল। পয়োনিষ্কাশনের বর্জ্য থেকে সৃষ্ট গ্যাস অথবা অন্য কোনো কারণে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সেটি তদন্তকারী সংস্থা যারা আছে, তারা ভালো বলতে পারবে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জে ইলিয়াছ দেওয়ানের মালিকানাধীন শত বছরের পুরোনো দোতলা ভবনে ১৮ মার্চ সকালে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণে পথচারী সিটি ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন আরও সাতজন। ওই ভবনের ব্যবসায়ীদের দাবি, গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, গণপূর্ত, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভেঙে ফেলা হয়।
বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্ত করে ফায়ার সার্ভিস নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক ফখরুউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের লিকেজ থেকে জমে থাকা গ্যাস থেকে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণের পর ওই সড়ক দিয়ে বুদ্বুদ করে গ্যাস উঠতে দেখা গেছে। ওই ভবনে আগেও দুবার গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল ও মৃত্যু হয়েছিল। সেখানে পয়োনিষ্কাশনের বর্জ্য থেকে গ্যাস বের হওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিস্ফোরণের পর ওই ভবন থেকে আলামত সংগ্রহ করতে আসা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, তারা ওই ভবনে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছে। তাদেরও ধারণা, গ্যাসের লিকেজ থেকে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া পুলিশ ওই ঘটনা তদন্ত করে জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে ওই ঘটনার নয় দিন পরও এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ দেননি।
এর আগে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শহরের তল্লা এলাকায় ‘বাইতুল সালাত জামে মসজিদে’ বাদ এশা গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে মসজিদের ইমামসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়, দগ্ধ হন আরও ৩ জন। বিস্ফোরণের পর তিতাসের লোকজন মসজিদের সামনের সড়কের মাটি খুঁড়ে তিতাসের সংযোগ দেওয়া সরকারি পাইপলাইনে নয়টি লিকেজ পান।