'সবার ভালোবাসায় আমরা এখনো বেঁচে আছি'

চিকিৎসক দম্পতি অনীক চন্দ ও মনিকা চন্দ, দুজনই করোনা আক্রান্ত। সংগৃহীত
চিকিৎসক দম্পতি অনীক চন্দ ও মনিকা চন্দ, দুজনই করোনা আক্রান্ত। সংগৃহীত

ফেসবুক খুলতেই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। নাকে অক্সিজেন নল লাগানো একজনকে পাশ থেকে ধরে আছেন এক নারী। ওই অবস্থায় আড়চোখে তাকিয়ে অনেক কষ্টে একটু যেন হাসলেন। পাশের নারীটির মুখেও ক্লান্তি ভরা হাসি। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পোস্ট করা এই ছবিতে ছোট করে ক্যাপশনে লেখা, 'সবার দোয়া আর ভালোবাসায় আমরা এখনো বেঁচে আছি।'

ছবিটি এক চিকিৎসক দম্পতির। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসক অনীক চন্দ ও তাঁর স্ত্রী মনিকা চন্দ। করোনাযুদ্ধের মাঠে নেমে দুজনই এখন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। যেখানে করোনা রোগীদের অনীক চিকিৎসা দিতেন সেখানেই, চমেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিজে এখন চিকিৎসাধীন। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের শুরু থেকে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন তিনি। নিজে আক্রান্ত জেনেও দিনরাত স্বামীর শুশ্রূষা করে যাচ্ছেন মনিকা। মনিকা করোনাকালেও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দিয়ে গেছেন।

গভীর এক সংকটে পড়েছে পুরো পরিবারটি। তাদের দুটি শিশু সন্তানের শরীরও ভালো নেই। সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন ছিলেন অনীক চন্দ। তাঁকে চার দিন আগে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশান কমে গেছে। হাই ফ্লো নজেল ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। তার আগে তাঁকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়।

অনীকের এজমা রয়েছে আগে থেকেই। তার পরও করোনাকালীন সময়ে তিনি চিকিৎসা দিতে পিছপা হননি। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন চমেক ফ্লু কর্নার ও করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করতেন। বাকি দিনগুলোতে রোগী দেখতেন মেডিসিন বহির্বিভাগে। এমনকি মা বাবার মৃত্যুর পরও দায়িত্বে অবহেলা করেননি তিনি।
গত ১ জুন তাঁর মা জয়শ্রী চন্দ মারা যান। তিনি লিভারের জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। তারও আগে মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাঁর বাবা অরুন চন্দ মৃত্যুবরণ করেন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আবার হাসপাতালে যোগদান করেন অনীক। গত ৮ জুন দুপুরে ফোনে অনীকের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি তখন চমেক হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে দায়িত্ব শেষ করেছেন সবেমাত্র।

অনীক বলেছিলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। চারদিকে সবাই আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। ইএমও (চমেক হাসপাতালের চিকিৎসক) মুহিদুল হাসানকে আমিই ওয়ার্ডে রিসিভ করেছিলাম। কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না। আমার নিজেরও শরীর ভালো না।
এরপরই অনীক বাসায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিছানায় শুয়ে ১০ জুন অনীক একটি পোস্ট দেন ফেসবুক পেজে, ‌'মা নেই আজ দশদিন হয়ে গেল। ভাবছি, কত সহজে কথাটা লিখে ফেলতে পারলাম! অথচ কয়েক দিন আগেও তো আমাদের পুরো জীবনটা ছিল মাকে ঘিরেই। মাকে সাজাতাম, বকা দিতাম, ঝগড়া করতাম, আদর করতাম বারবার। আসলে মা তো ছিল আমাদের খেলার পুতুল। মা চলে যাওয়ার পর থেকে পুরোনো হাঁপানির সমস্যাটা ভুগিয়ে চলেছে খুব।'

করোনা আক্রান্ত স্বামী অনীকের সঙ্গে হাসপাতালে স্ত্রী মনিকা। ছবি

১১ জুন ছিল তাঁর প্রয়াত মায়ের পারলৌকিক শ্রাদ্ধ। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি তাতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। সেদিন তাঁর স্ত্রী মনিকা চন্দ দুঃখ করে ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিলেন, 'আজকে মায়ের কাজ (শ্রাদ্ধ)। কিন্তু আমরা যেতে পারিনি। অনীকের শরীরটা বেশ খারাপ, বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি। আজকে মায়ের কাজ শেষ হলে, অনীক একটু সুস্থ হলে, সব গুছিয়ে অন্য জীবনে প্রবেশ করব।'

তার দুদিন পর অনীক তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকেই শুরু জীবনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ করোনার বিরুদ্ধে। পরম ভালোবাসা আর যত্নে স্বামীর পাশে আছেন চিকিৎসক স্ত্রী মনিকা। একসময় মনিকা জানলেন তিনি নিজেও পজিটিভ। অনীকের সহকর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস অনীক আস্তে আস্তে আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুস্থ হয়ে আবার করোনাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানবিকতায় এগিয়ে যান মানুষের আশীর্বাদ ও ভালোবাসা তাঁর চিরসঙ্গী।

তাইতো কাল (শুক্রবার) আইসিইউ থেকে মনিকার পোস্ট করা ছবিতে ভালোবাসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁদের বন্ধু বান্ধব শুভানুধ্যায়ী আর রোগীরা। শত শত মন্তব্যের সারমর্মটা এ রকম, 'করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমরা জিতে যাও। তোমরা জিতলে আমরাও জিতব।'