'সবই নদী গিলে খেল'

মাদারীপুরে বন্যায় পানিবন্দী চরাঞ্চলের দুই হাজারের বেশি পরিবার। চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। গতকাল দুপুরে শিবচর উপজেলার চরজানাজাত এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
মাদারীপুরে বন্যায় পানিবন্দী চরাঞ্চলের দুই হাজারের বেশি পরিবার। চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। গতকাল দুপুরে শিবচর উপজেলার চরজানাজাত এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো

‘জীবনের শুরু থিকা চরে বাস করি। তখন নদীর ভাঙন ছিল মেলা দূরে। গত বছরও ভাবি নাই এ বছর আমাগো সব শ্যাষ হইয়া যাইবে। চোখের সামনে আমাগো যা ছিল, সবই নদী গিলে খেল।’ বলছিলেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চর জানাজাত ইউনিয়নের মিনাকান্দি এলাকার ষাটোর্ধ্ব জেলে জোহরুদ্দিন মিয়া।

দুই সপ্তাহ আগে বসতঘর, জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায় জোহরুদ্দিনের। এরপর দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের ভিটায়। শুধু জোহরুদ্দিনের পরিবার নয়, এমন আরও দুই শতাধিক পরিবার পদ্মার ভাঙনে এখন দিশেহারা।

শিবচর উপজেলার চারটি ইউনিয়নজুড়ে পদ্মার চরাঞ্চল। বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে যাওয়ায় বুকপানিতে তলিয়ে গেছে চরাঞ্চলের বেশির ভাগ জমি। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের প্রায় ২ হাজার ৪০০ পরিবার। উঁচু জায়গাগুলোতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ নদীভাঙন।

গতকাল মঙ্গলবার চর জানাজাত ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতিটি গ্রামে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। কোথায়ও কোমরপানি, কোথায়ও বুকপানি। পানির মধ্যেই এখনো বসবাস করছে কিছু মানুষ। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু স্থানে। অনেকে বাড়িঘর ভেঙে ও গবাদিপশু নৌকায় তুলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, গত সাত–আট বছরের ভাঙনে চর জানাজাত ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮টিই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কেবল ৯ নম্বর ওয়ার্ড এখনো বিলীন হয়নি। সবচেয়ে বেশি নদী ভাঙছে এ বছর।

একে একে দুবার নদীতে বিলীন হয়েছে আমিনা খাতুনের বসতঘর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীর পারে আমাগো অনেক জমিজমা ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন সব শ্যাষ।’উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রমতে, দুই সপ্তাহ ধরে পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বাড়ায় শিবচরের চরাঞ্চলের বন্দরখোলা, চর জানাজাত, কাঁঠালবাড়ি, মাদবরেরচরসহ ৯টি ইউনিয়নে বন্যার পানি উঠেছে। নদী ভাঙছে চারটি ইউনিয়নে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চর জানাজাত ইউনিয়ন। পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে গত বছরে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদ ভবন ও অস্থায়ী বাঁধের প্রায় ৫০ মিটার। পানিতে তলিয়ে গেছে বসতঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যুতের খুঁটিসহ অসংখ্য ফসলি জমি। এ ছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবন, প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন, একটি বাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ।

জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে সরকারি সহযোগিতা করা হবে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের খাসজমিতে ঘর করে আশ্রয় দেওয়া হবে।

পরিস্থিতির উন্নতি

বন্যাকবলিত বেশির ভাগ জেলায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নীলফামারীর তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গতকাল বেলা তিনটায় লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর ডালিয়া পয়েন্টে সন্ধ্যা ছয়টায় পানি ছিল বিপৎসীমার ৫২ দশমিক শূন্য ৮ সেন্টিমিটার নিচে। কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদ–নদীর পানি কমলেও নিচু এলাকাগুলো এখনো পানিতে তলিয়ে আছে।

বগুড়ায় যমুনার পানি এখন বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচে। জামালপুরের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি কমেছে। টাঙ্গাইলে নদ-নদীর পানি কমতে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। গতকাল ধলেশ্বরীর পানি ৬৬ সেন্টিমিটার ও ঝিনাই নদের পানি ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও যমুনার পানি ছিল বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার নিচে। মানিকগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল শিবালয় ও দৌলতপুরে যমুনার পানি ছিল বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচে। ফরিদপুরে পানি কমতে শুরু করলেও আগামী দু–এক দিনের মধ্যে আবার বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পদ্মার তীরে বাঁধ না থাকায় মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের মেদেনীমণ্ডল ইউনিয়নের দুটি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এদিকে সিলেটে নদ–নদীর পানি কমছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে সুনামগঞ্জে।