৭০ বছর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে বাবা কালু মুন্সির কবর জিয়ারত করেছেন আবদুল কুদ্দুস মুন্সি। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেয়ে শিউলি আক্তার, ছোট ছেলে সোহেল রানাসহ আটজন।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামে যাওয়ার পরপরই আবদুল কুদ্দুস (৮০) বললেন, ‘বৃদ্ধ মা মঙ্গলের নেছাকে রাজশাহী নিয়ে যেতে চাই।’
জানা গেছে, বেলা ১১টার দিকে আগে ছোট বোন ঝরনার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাফবাদ গ্রামের বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী নবীনগরের বাড্ডা গ্রামে উদ্দেশে বের হন আবদুল কুদ্দুস। সঙ্গে নেন মেয়ে শিউলি আক্তার, ছোট ছেলে সোহেল রানাসহ আটজনকে। অসুস্থ থাকায় মা মঙ্গলের নেছাকে নিতে পারেননি। দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছান বাড্ডা গ্রামে। সেখানে জন্মভিটায় থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন ওই বাড়িতে ভিড় জমান। বিকেল পাঁচটার দিকে বাড্ডা গ্রামের কাজীরগাঁও মহল্লার মসজিদে নামাজ পড়েন তিনি। এরপর কাজীরগাঁওয়ের কবরস্থানে গিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করেন।
বিকেলে বাড্ডা গ্রামে গিয়ে আবদুল কুদ্দুসকে জন্মভিটায় বসে গল্প করতে দেখা যায়।
কুদ্দুসের সমবয়সী বন্ধু হাফিজ মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলায় খ্যাতে আমরা একসঙ্গে বইসা আছিলাম। তহন কুদ্দুস হঠাৎ কইরা ইন্দুরের গাতায় হাত দেন। ইন্দুর তারে কামড় দিছে। সে সময় বাপ (কালা মুন্সি) গিয়ে কুদ্দুসের পিঠে চড় দিছে। একসাথে খেলার কথা বলছি। পরে কুদ্দুস আমারে চিনতে পারছে। তবে কুদ্দুসের চেহারাডা ভাইঙ্গা গেছে।’
কুদ্দুসের ভাতিজা আহসান হাবীব বলেন, ‘কুদ্দুস চাচা ফিরা আইব কোনো দিন ভাবছি না। অনেক বালা লাগতাছে।’
কুদ্দুসের নাতি জিসান আহমেদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দাদার গল্প শুনে আসছিলাম। দাদা এমন, দাদা অমন। দাদা পড়াশোনা করতে রাজশাহী গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি হারিয়ে যান বলে শুনেছি।’
কথা হলে আবদুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঘরগুলো তখন ছিল না। এখানে ছোটবেলার ১০ বছর কেটেছে। ছোটবেলায় চাচা আক্কেস মিয়ার সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। খেলার সময় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় ব্যথা পেয়েছিলাম। সেখানে কাটা চিহ্ন আছে।’
হাতের ক্ষত অংশটি প্রতিবেদককে দেখিয়ে আবদুল কুদ্দুস আরও বলেন, ‘রাজশাহীর আত্রাইয়ে থাকাকালীন আমার তিনজন মা হতে চেয়েছিল।’ জানতে চাইলে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘তিনজন মহিলা নিজেদের আমার মা বলে দাবি করেছিল। তারা অনেকেই অনেক কিছু বলেছিল। আমার শরীরের অনেক দাগ ও জখম রয়েছে, তারা জানিয়েছে। কিন্তু আমি তাদের কিছুই বলিনি।’
আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘একমাত্র আমার আসল মা-ই আমার হাতের কাটা চিহ্নের কথা বলেতে পেরেছেন। আমি আর এক-দুই দিন মায়ের সঙ্গে থাকব। তবে মাকে রাজশাহীর আত্রাইয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমার। এখন মা রাজি হলেই সেখানে নিয়ে যাব। কারণ বাকিটা জীবন মায়ের সঙ্গে কাটাতে চাই।’
নবীনগরের বাড্ডা গ্রামের প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীর আত্রাইয়ে আবদুল কুদ্দুস মুন্সির অনেক সম্পত্তি। সম্পত্তির জন্যই হয়তো তিনজন মহিলা নিজেদের আবদুল কুদ্দুসের মা বলে দাবি করেছিলেন।
জানা গেছে, আবদুল কুদ্দুসের বয়স যখন ৬-৭ বছর, তখন তাঁর বাবা কালু মুন্সি মারা যান। এরপর মা মঙ্গলের নেছা তাঁকে পড়াশোনার জন্য পুলিশ সদস্য ফুফা আবদুল আউয়ালের কাছে রাজশাহীর বাগমারায় পাঠান। ১০ বছর বয়সে ফুফুর বকা খেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হন আবদুল কুদ্দুস। ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংহগ্রামে। সেখানে একজন নারীর আশ্রয়ে ছিলেন বেশ কিছুদিন।
এরপর চলে যান ওই এলাকারই দুই বোন সুন্দরী ও কপিজানের আশ্রয়ে। তাঁদের যত্নে বেড়ে উঠে আত্রাইয়ের চৌবাড়ি গ্রামে বিয়ে করেন। সংসারে আসে তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। ৭০ বছর পর শুক্রবার সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছলিমাবাদ ইউনিয়নের আশ্রাফবাদ গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন আবদুল কুদ্দুস। শনিবার দুপুর পৌনে ১২টায় বৃদ্ধ মা মঙ্গলের নেছা (১১০) ও একমাত্র ছোট বোন ঝরনা বেগমের সঙ্গে আবদুল কুদ্দুসের দেখা হয়।