মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। সবার লক্ষ্য পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে সম্ভ্রম ও প্রাণ রক্ষা করা।
১৯৭১ সালের ২২ মে বেলা তিনটা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাজার, হাটে-মাঠে ব্যস্ত। নারীরা দুপুরের রান্না ও খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। হঠাৎ বিকট শব্দ, কীর্তিনাশা নদীর তীরে কামানের গোলা ও বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ।
মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। সবার লক্ষ্য পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে সম্ভ্রম ও প্রাণ রক্ষা করা।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার হিন্দু–অধ্যুষিত দক্ষিণ মধ্যপাড়া, উত্তর মধ্যপাড়া, কাশাভোগ ও রুদ্রকর গ্রামে ৫০ বছর আগের ওই দিনের চিত্রই ছিল এমনই।
৮৬ বছরের বিজয়া মালো সেদিনের ভয়াল সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। পাকিস্তানি সেনাদের বন্দিদশায় নির্যাতনের কথা মনে হলে ৫০ বছর পর আজও তিনি শিউরে ওঠেন। ওই সময় সইতে হয়েছে অনেক গঞ্জনা আর কষ্ট, এরপরও এখন পর্যন্ত তাঁকে দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অভাব-অনটনে কাটছে দিন।
দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের গৃহবধূ ছিলেন বিজয়া মালো। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ৩৬ বছর। চোখের জল মুছতে মুছতে ২৭ মার্চ তিনি প্রথম আলোর কাছে একাত্তর ও এর পরবর্তী সময়ের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২২ মে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের হিন্দুপাড়াগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা চালায়। স্বামী পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে সাহস পাইনি। আতঙ্ক ও ভয় নিয়ে ঘরেই ছিলাম। ২৩ মে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ঘর থেকে টেনে বের করে। উঠানে অন্তত ১০০ নারী ও পুরুষের সঙ্গে আমাকে বসায়। নারীদের উঠানে রেখে পুরুষদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ৩০-৩৫ জন নারীর সঙ্গে কীর্তিনাশা নদীর তীরে নিয়ে লঞ্চে তোলে। নিয়ে যাওয়া হয় মাদারীপুর এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে চার দিন আটকে রেখে পাকিস্তানি সেনারা পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাঁচ দিন পর সে নরক থেকে ছাড়া পাই। গ্রামে ফিরে দেখি বাড়িঘর নেই, ভিটিতে ছাই পড়ে আছে। স্বজনদের খুঁজে পাই না। পাশের গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। সাত দিন পর স্বামীকে খুঁজে পাই। ওই দিনই বাড়ির পাশের একটি বাগান থেকে ভাশুর হীরালাল মালোর অর্ধগলিত লাশ পাওয়া যায়। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।’
বিজয়া মালো আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর নানা চাপে আমাকে শ্বশুর আর স্বামীর ভিটেমাটি হারাতে হয়েছে। স্বামী গোষ্ঠগোপাল মালো ২৮ বছর আগে মারা গেছেন। তিন ছেলে জীবিত। তাঁরা জেলে পেশায় নিয়োজিত। তাঁরা নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালান। বড় ছেলের সঙ্গে মাদারীপুরে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে একটি বস্তিঘরে বসবাস করছি। মুক্তিযুদ্ধে আমার ও আমার পরিবারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের সেই সম্মান দেয়নি।’
১৯৭১ সালের মধ্যপাড়ার ওই ঘটনা নিয়ে ২০১০ সালের ২৬ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ তালুকদার। ১৯৭১ সালের ২২, ২৩ মে ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে বন্দী থাকা অবস্থায় নির্যাতনের ঘটনার লিখিত বিবরণ ওই মামলার সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন বিজয়া মালো। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষীর ভিত্তিতে ওই মামলার আসামি সোলায়মান মোল্যা ও ইদ্রিস আলীকে ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। সোলায়মান ওই বছর কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যান আর ইদ্রিস পলাতক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সামাদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা মধ্যপাড়া ও আশপাশের হিন্দুপল্লির অন্তত ৩৫-৪০ নারীকে মাদারীপুর এআর হাওলাদার জুট মিলে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা তাঁদের খুঁজে বের করে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। এখনো তাঁরা অনেকে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন, কষ্টে জীবন পার করছেন।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁদের জীবন ও নির্যাতন স্বীকারের মধ্য দিয়ে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জন, তাঁদের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। তাঁদের ও তাঁদের পরিবারকে খুঁজে বের করে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। যাঁরা এখনো স্বীকৃতি পাননি, তাঁরা আবেদন করলে জেলা প্রশাসন সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণের ব্যবস্থা করবে।’