চাকমা, মারমা, খুমি, মাহ্লেসহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনে ধর্ষণের মতো ঘটনা ছিল না বলেই এর প্রতিশব্দও তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশের ৩২টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণ শব্দের প্রতিশব্দ নেই।
এর বাইরে ম্রোদের কিছু অংশ রেংমিটসা ভাষায় কথা বলত। এই ভাষাতেও ধর্ষণের প্রতিশব্দ নেই।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাপন খুব সাদাসিধে, সেটি পাহাড়ে বা সমতলে যেখানেই তারা থাকুক। তাদের সমাজে অপরাধপ্রবণতাও কম। এর প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতি ও ভাষায়। বাংলা ভাষায় ‘ধর্ষণ’ নামে জঘন্য যে অপরাধ, সেটি বেশির ভাগ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজে নেই।
গবেষকেরা দেশের ৩২টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৩৩টি ভাষায় ধর্ষণের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ খুঁজে পাননি। ঐতিহাসিকভাবে এসব মানুষের জীবনাচারে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ না ঘটায়, তাদের ভাষায় এই শব্দ তৈরি হয়নি। তবে এর মধ্যে কয়েকটি ভাষা হারিয়ে গেছে, আবার কয়েকটি ভাষার লিখিত রূপ এখন আর নেই।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দেশজুড়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার ওপর সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কাজ শেষ করেছে। ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক (প্রকাশনা ও গবেষণা পরিকল্পনা) মো. ইলতেমাস প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষা রয়েছে।
যেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণ শব্দটি নেই, তার মধ্যে রয়েছে খুমি। এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা থাকে বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি—এই তিন উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে। অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত খুমি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। বাংলাদেশ খুমি সামাজিক সংগঠনের সভাপতি লেলুং খুমি বলেন, শহুরে সভ্যতা থেকে বহু দূরে থাকা খুমিদের ভাষায় ‘ধর্ষণের’ কোনো প্রতিশব্দ নেই।
মারমা ভাষায় ধর্ষণের প্রতিশব্দ না থাকলেও নারীকে অপহরণের প্রতিশব্দ রয়েছে বলে জানান লেখক মংক্য শোয়েনু নেভীর।
যদিও গবেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণের প্রতিশব্দ নেই বলে বিষয়টিকে সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজেও নারীরা এখন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা বলতে পারছেন না। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। অপমানে আত্মহত্যাও করছেন কেউ কেউ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বখতিয়ার আহমেদ ‘পরিচয় ও উন্নয়নের রাজনীতি’ বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঙ্খো ভাষায় ‘ধর্ষণের’ প্রতিশব্দ নেই। শুধু তা-ই নয়, এই ভাষায় মজুরি শব্দটিও নেই। কারণ, আশির দশকের আগে তাদের শ্রম বিক্রি করার কোনো রেওয়াজ ছিল না। তারা একে অন্যের জমিতে কাজ করত। তার বিনিময়ে ভালো থাকা-খাওয়া ও সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আর ছোটবেলা থেকেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হয় না। তারা একসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে।
সম্প্রতি রাজশাহীর একটি গির্জায় এক মাহ্লে (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। স্থানীয় সমাজপতিরা সালিস করে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মেয়েটির পরিবারকে বোঝানো হয়েছে, সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত তার সব দায়দায়িত্ব বহন করা হবে। এটা না মানলে তারা ঝামেলায় পড়বে। পরে অবশ্য মামলা হয়। গির্জা থেকেও মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। তার ভাই এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁদের ভাষায় ধর্ষণ বলে কোনো শব্দ নেই।
এর আগে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল রাতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আরেক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। তাঁর বাবা গোদাগাড়ী থানায় মামলা করলেও ভয় দেখিয়ে আপস করানো হয়। এরপর আসামিরা খালাস পেয়ে আবার মেয়েটির পিছু লাগেন। একপর্যায়ে অপমান সইতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীর তানোরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৮ বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় করা মামলাটি এখনো বিচারাধীন। আর ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তানোরে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রীকে অপহরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে আগে সালিসের চেষ্টা হয়। পরে থানায় মামলা হয়।
এ ধরনের ঘটনা থেমে নেই। ২০১১ সালের জুলাই মাসে গোদাগাড়ীর সিমলা দীঘিপাড়া গ্রামে মরিয়ম মুর্মুকে (৫০) ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ছিল ভয়াবহ। মরিয়ম দীঘিপাড়া গ্রামে বয়স্ক শিক্ষা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এ মামলায় তিন আসামির ফাঁসির দণ্ড হয়েছে।
কবি মিঠুন রাকসামের মাতৃভাষা গারো। তিনি বলেছেন, গারো ভাষায় সরাসরি ধর্ষণের কোনো প্রতিশব্দ নেই, তবে গারো আইনে কারও শায়িত অবস্থায় গোপনে ঘরে প্রবেশপূর্বক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উপগত হওয়ার চেষ্টা বোঝাতে ‘সিক্দ্রা’ ও যৌন উৎপীড়নের চেষ্টা বোঝাতে ‘সাল্দ্রা’ শব্দের ব্যবহার আছে।
গবেষকেরা বলছেন, যাদের জীবনে ঐতিহাসিকভাবে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ছিল না, এখন তারা সেই ঘটনার শিকার হচ্ছে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন সমর এম সরেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষায় ধর্ষণ শব্দের প্রতিশব্দ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে সদ্য পরিচিত হওয়া কন্দ, সৌরা, খাড়িয়া ভাষাভাষীদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তাদের ভাষাতেও ধর্ষণ শব্দের প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি। তবে গত দুই বছরে সাঁওতালি ও মণিপুরি ভাষায় বেশ কিছু অনলাইন কনটেন্ট ও ওয়েবসাইট নির্মিত হওয়ায় সেখানে এর প্রতিশব্দ হিসেবে কাছাকাছি কিছু সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হলেও এখন পর্যন্ত এসব শব্দ ব্যবহারে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রথাগত সমাজে ত্রাসনির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত। এ জন্য সেখানে ধর্ষণের মতো বল প্রয়োগও সাধারণত ঘটে না।বখতিয়ার আহমেদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক ও গবেষক সুগত চাকমা বলেন, চাকমারা পাহাড়ি এলাকায় ছোট ছোট দলে বাস করে। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। তাই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে না। তবে চাকমা ভাষায় ধর্ষণের প্রতিশব্দ না থাকলেও বলাৎকারের কাছাকাছি একটা শব্দ আছে বলে জানান আরেক গবেষক শুভাশীষ চাকমা।
গবেষকেরা বলছেন, সাঁওতাল, মুন্ডারি, মাহ্লে, খাসি, কোল, খাড়িয়া, শাউরা, কোডা, লিঙ্গাম, ত্রিপুরা, মান্দি, পাত্র, খুমি, পাঙ্খো, রাখাইন, মণিপুরি, কোচ, লুসাই, মারমা, ম্রো, বম, চাক, খিয়াং, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, হাজং, সাদরি, তঞ্চঙ্গ্যা, কানপুরি, কুড়ুখ, মালতো, কন্দ—এই ৩২টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ধর্ষণ শব্দের প্রতিশব্দ নেই। এর বাইরে ম্রোদের কিছু অংশ রেংমিটসা ভাষায় কথা বলত। এই ভাষাতেও ধর্ষণের প্রতিশব্দ নেই। তবে ‘রেংমিটসা’ আলাদা কোনো জাতিগোষ্ঠী নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রথাগত সমাজে ত্রাসনির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত। এ জন্য সেখানে ধর্ষণের মতো বল প্রয়োগও সাধারণত ঘটে না।