শরীয়তপুরে আ.লীগ নেতা হাবীবুর হত্যা

১৯ বছর আটকে আছে বিচারকাজ, শঙ্কায় পরিবার

হাবীবুর রহমান
সংগৃহীত ছবি

২০০১ সালের ৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় শরীয়তপুর জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি (সরকারি কৌঁসুলি) হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেনকে। হাবীবুর রহমান তখন আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মনির হোসেন ছিলেন পৌরসভা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯ বছর পার হলেও মামলার কার্যক্রম তেমন এগোয়নি।

মামলার বাদী জিন্নাত রহমান। তিনি হাবীবুর রহমানের স্ত্রী। ২০১৮ সালে মারা যান জিন্নাত। এরপর পরিবারের সদস্যরা শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল।

৭ অক্টোবর নির্বাচন হয়। ৫ অক্টোবর হাবীবুর রহমানের বাসভবনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সভা চলছিল। সেখানে হামলা চালান আওরঙ্গ-সমর্থক যুবলীগের সাবেক নেতা সরোয়ার হোসেন বাবুল তালুকদারের লোকজন।

মামলার এজাহার ও বাদীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জাজিরা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। তখন আওরঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। ৭ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে ৫ অক্টোবর শহরে হাবীবুর রহমানের বাসভবনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সভা চলছিল। সেখানে হামলা চালান আওরঙ্গ-সমর্থক যুবলীগের সাবেক নেতা সরোয়ার হোসেন বাবুল তালুকদারের লোকজন। বাবুলের তাঁর ভাই মন্টু তালুকদার গুলিবিদ্ধ হন। কিছুক্ষণ পরে ওই বাসভবনে আবার হামলা হয়। তখন হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেন খুন হন।

হাবীবুর রহমানের স্ত্রী জিন্নাত রহমানের করা হত্যা মামলায় আওরঙ্গকে প্রধান আসামি করা হয়। মোট ৫৫ ব্যক্তিকে আসামি করেন তিনি। পুলিশ তদন্ত শেষে আওরঙ্গর নাম বাদ দিয়ে ২০০৩ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। মামলার বাদী তখন আদালতে নারাজি দেন। আদালত ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর জিন্নাত রহমান উচ্চ আদালতে রিট করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন আওরঙ্গ। তিনি নানাভাবে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আওরঙ্গ মারা যান। এরপর উচ্চ আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন পুলিশকে। পুলিশ ২১০৩ সালের অক্টোবরে আদালতে ৫৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

অনেকেই আমাদের পাশে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে ছিলেন, তাই এখনো মামলাটি টিকে আছে। একটা সময় স্থানীয় আইনজীবীদেরও পাশে পাইনি।
পারভেজ রহমান, নিহত হাবীবুর রহমানের ছেলে

আওরঙ্গ ছাড়াও মামলার আসামি স্বপন কোতোয়াল, শাহজাহান মাঝি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর চারজন চলে গেছেন বিদেশে। বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন। অধিকাংশ আসামি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত।

প্রয়াত হাবীবুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আর মনির হোসেনের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। হাবীবুর রহমানের ছেলে পারভেজ রহমান শরীয়তপুর জজ আদালতের আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে বাবা-চাচাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন আমরা শিশু ছিলাম। অনেকেই আমাদের পাশে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে ছিলেন, তাই এখনো মামলাটি টিকে আছে। একটা সময় স্থানীয় আইনজীবীদেরও পাশে পাইনি। তখন আইনজীবী সাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) শরীয়তপুরে এসে মামলার শুনানিতে অংশ নিতেন। বাবা-চাচা হত্যার বিচার না দেখেই মা মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন আমরাও শঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যে আছি।’

কারও নাম উল্লেখ না করে পারভেজ রহমান বলেন, ‘আসামিরা অনেক প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় আছেন, এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমাদেরও বাবা-চাচার মতো পরিণতি হবে, এমন হুমকি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। বাবা জেলার সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা, জজ আদালতের পিপি ও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। অথচ মামলাটির বিচারকাজ ১৯ বছর ধরে আটকে আছে।’

জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা জজ আদালতের পিপি মীর্জা হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, আসামিপক্ষ বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালত থেকে মামলার কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনে। তবে প্রধান আসামির মৃত্যুর পর মামলার কার্যক্রম আবার নিম্ন আদালতে শুরু হয়। এখন সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির কার্যক্রম চলছে।