‘হুজুরের পরামর্শে’ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নিয়ে কথা বলেছেন কাটাখালীর মেয়র

ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড বিষয়ে ফেসবুক লাইভে বক্তব্য দিচ্ছেন কাটাখালী পৌর মেয়র আব্বাস আলী
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া অডিওর কণ্ঠটি তাঁর নিজের বলে স্বীকার করেছেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র মো. আব্বাস আলী। আজ শুক্রবার বিকেলে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলেন, স্থানীয় একটি মাদ্রাসার বড় হুজুরের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ম্যুরাল না রাখার কথা কথাচ্ছলে বলেছিলেন। এটা তিনি ভুল করেছেন বলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ক্ষমা চান। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের দীর্ঘ লাইভ ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘আজকে শুধু ১ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের (অডিও রেকর্ড) কথা বলব। আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করিনি। আমি শুধু বলেছি, আমি ম্যুরালটা করলে ইসলামে ঠিক হবে না। এটা পাপ হবে। আমি এই ম্যুরাল এখানে করব না। এইটুকুই সেদিন বলেছি। কিন্তু এ বিষয়ে পরবর্তীতে ম্যুরালটা যে আর করা হবে না, এটা বলা হয়নি। একটা গল্পচ্ছলে, আড্ডাতে বসে নিজেদের মধ্যে বলেছি। অনেকেই তো গল্প করে। আমিও হয়তো করেছি। এটাতে যদি ভুল হয়ে থাকে, আমি ভুল করেছি। আমি এ জন্য ক্ষমা চাই।’

মেয়র আব্বাস আলী প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘ওই অডিও আপনারা ভালো করে শুনুন। কোথাও কি আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করেছি, কোনো অশালীন মন্তব্য করেছি। আমি কোনো কটূক্তি, অশালীন মন্তব্য করি নাই। বঙ্গবন্ধু এই দেশে জন্মেছিলেন বলেই এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এটা শুধু আওয়ামী লীগই বিশ্বাস করে না, আমিসহ সকলে এটা বিশ্বাস করে। এখানে তাঁকে নিয়ে সমালোচনার কোনো সুযোগ নেই। আমি তাঁকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করিনি। কিন্তু ম্যুরাল নিয়ে আমার কথা অডিওর মধ্যে আছে।’

আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করিনি। আমি শুধু বলেছি, আমি ম্যুরালটা করলে ইসলামে ঠিক হবে না। এটা পাপ হবে। আমি এই ম্যুরাল এখানে করব না। একটা গল্পচ্ছলে, আড্ডাতে বসে নিজেদের মধ্যে বলেছি। এটাতে যদি ভুল হয়ে থাকে, আমি ভুল করেছি। আমি এ জন্য ক্ষমা চাই।
মো. আব্বাস আলী, মেয়র, কাটাখালী পৌরসভা

অডিও রেকর্ডটি ৩-৪ মাস আগে করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত ২৯ মে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরালের ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করে জানতে চেয়েছিলেন, কোনটি বেশি ভালো হবে। এই ম্যুরালের ভিডিও আপলোড দেওয়ার পর জামিয়া উসমানিয়া মাদ্রাসায় একটি জানাজায় গিয়েছিলেন। জানাজা শেষে তিনি মাদ্রাসায় বসেছিলেন। এই মাদ্রাসার বড় হুজুর অনেক পরিশ্রম করে মাদ্রাসাটা করেছেন। এই মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার ছাত্র মুফতি, আলেম, হাফেজ হয়েছেন। আজ তাঁর অনুসারী সারা বাংলাদেশে। সেদিন ম্যুরালের ভিডিও প্রসঙ্গে হুজুর বলেন, ‘ভিডিওটা দেখলাম। আমার এক ছাত্র দেখাল। তো ম্যুরাল বিষয়ে কোনো চেঞ্জ আনা যায় না?’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘হুজুর, ম্যুরালটার বিষয়ে কী সমস্যা?’ তখন হুজুর এ বিষয়ে অনেক ব্যাখ্যা করলেন। মেয়র বলেন, ‘আমিও তো মানুষ। আমি মুসলমান। আল্লাহ প্রসঙ্গ আসলে, কোরআনের প্রসঙ্গ আসলে কে না দুর্বল হয়। আমিও একটু দুর্বল হয়েছিলেন সেদিন।’

মেয়র কেঁদে কেঁদে ‘বিবেকবান’ মানুষের উদ্দেশে বলেন, ‘এই ভুলের জন্য আজকে ফেসবুকে কতজন কত কথা বলছে। আপনারা সারা বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ। আমি ভুলটা কত বড় ভুল করেছি? কী এমন ভুল করেছি যে আমাকে ফেসবুকে গালিগালাজ করতে হবে। আমার বিরুদ্ধে মিছিল করল, ভাঙচুর করল। আমি ভুল করেছি। আমাকে শাস্তি দিন। আইসিটি আইনে আমার নামে তিনটি মামলা দিল, আমাকে পবা উপজেলা দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, তবু আমি মেনে নিয়েছি। আমার ভালোবাসার মানুষ যাঁরা আছে, তাঁদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাল। তাঁদের থ্রেট করা (হুমকি) অব্যাহত আছে। কাউন্সিলরদের ডেকে নিয়ে থ্রেট করে জোরপূর্বক তাঁদের দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে, তার ডকুমেন্টস আমার কাছে আছে। তারপরে দোকানপাট, ছোট্ট সোনামনিদের শিশুপার্ক করেছিলাম। আমাদের এলাকায় শিশুদের কোনো খেলার জায়গা নেই। বছরের পর বছর অনেক কষ্টে শিশুপার্কটি করেছিলাম। শিশুদের খেলনাগুলোকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। কী দোষ করেছিল ওরা, আমি জানি না।’

তাঁর ভুলের শাস্তি কত বড় এই প্রশ্ন রেখে মেয়র বলেন, ‘আমি যদি ভুল করে থাকি, সে জন্য আমি ক্ষমা চাই। তারপরও যদি মনমতো না হয়, আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দেবেন, বহিষ্কার করবেন, আমার নামে মামলা করবেন। কিন্তু একের পর এক অত্যাচার-জুলুম কেন করাচ্ছেন। আমার বাড়িতে অসুস্থ এক মা তিন-চার দিন ধরে অনাহারে আছেন। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হয়েছে। আমার বাড়িতে আর্মস-মাদক রেখে আমার মা ও বউকে ধরে নিয়ে...আমি কি এত বড় অন্যায় করেছি। অন্যায় করলে তো আইন আছে, তাই বলে এভাবে? এভাবে নোংরামি করে রাজনীতি করে হয়রানি করা, এটা কি ঠিক?’

রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ সম্পর্কে কাটাখালী মেয়র বলেন, ‘২০০২ সালে মহানগর যুবলীগ দিয়ে আমার রাজনীতির শুরু। তার আগে কোনো দিন কোনো দল করিনি। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে, আমি অন্য কোনো দল জীবনে করেছি, তবে আমি সুইসাইড করব।’

‘বিবেকবান’ মানুষ পাশে থাকলে আবার লাইভে আসবেন জানিয়ে মেয়র আব্বাস বলেন, ‘আমাকে বলা হচ্ছে আমি শত শত কোটি টাকার মালিক। আমাকে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী বানানো হচ্ছে। একের পর এক কেন এত ষড়যন্ত্র? এর পেছনে কারা জড়িত? এর পেছনে কারা, কী কারণে তাঁরা এটা করছেন, এগুলো পরবর্তীতে একটা একটা করে সবগুলো খোলাসা করা হবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

আব্বাস আলী কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে টানা দুই মেয়াদে মেয়রের দায়িত্বে আছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ উঠেছে। এ–সংক্রান্ত একটি অডিও কথোপকথন গত মঙ্গলবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

তবে মেয়র আব্বাস গত বুধবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেন, অডিওটি এডিট করা। অডিওর কথোপকথনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করায় রাজশাহীজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। ইতিমধ্যে এ নিয়ে রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলাও হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেপ্তারসহ আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে অনড় রয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে আজ অনাস্থা প্রকাশ করেছে কাটাখালী পৌরসভার সব কাউন্সিলর। তার আগে বুধবার তাঁকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানিয়েছে পবা উপজেলা আওয়ামী লীগ।