শাশুড়ির ঢেলে দেওয়া গরম পানিতে ঝলছে গেছে পুত্রবধূ মোখলেছিনা বেগমের (৩০) মাথা, ঘাড় ও গলা। তাঁর বাঁ চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তীব্র যন্ত্রণায় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুদিন ধরে তিনি ছটফট করছেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার সকাল ১০টার দিকে।
মোখলেছিনার বাড়ি বদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ বাওচণ্ডী খিয়ারপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা মতিয়ার রহমান একজন বর্গাচাষি।
ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক নাজমুল হুসাইন বলেন, ‘গত সোমবার বিকেলে মোখলেছিনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর মাথা, গলা ও ঘাড় পুড়ে গেছে। গরম পানিতে তাঁর বাঁ চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিদিন তাঁর পোড়া ক্ষতে ড্রেসিং করা হচ্ছে। চেষ্টা করছি, এখানেই চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে।’
আজ বুধবার বেলা ১১টায় গিয়ে দেখা যায়, ওই হাসপাতালের শয্যায় মোখলেছিনা পোড়া ক্ষতের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১১ বছর বয়সে মা–বাবা তাঁকে বিয়ে দেন রংপুর সদরের দরিদ্র ছাদেক আলীর বেকার ছেলে জিয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তখন জিয়ারুলের বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর।
মোখলেছিনা অভিযোগ করে বলেন, মাত্র ১১ বছর বয়সে বধূবেশে স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। প্রথম দিনে মাছ কাটতে না পারার কারণে শাশুড়ি তাঁকে মেরেছিলেন। এরপর থেকে প্রায় দিনেই কারণে–অকারণে শাশুড়ি জেলেখা বেগম, দেবর জিয়াদুল ইসলাম ও জা মরিয়ম বেগম তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন। ভয়ে এসবের প্রতিবাদ করতেন না স্বামী। সংসারের কথা ভেবে সব সহ্য করে যেতেন মোখলেছিনা। পরে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দুই সন্তানকে মা–বাবার কাছে রেখে স্বামী তাঁকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে ৯ বছর অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেছেন মোখলেছিনা। স্বামী ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। করোনা শুরুর পর তিনি ঢাকা থেকে স্বামীর বাড়িতে ফিরে এলেও স্বামী ফেরেননি।
মোখলেছিনার অভিযোগ, ঢাকা থেকে ফেরার পর তাঁর ওপর শুরু হয় আবারও সেই নির্যাতন। গত সোমবার সকালে তাঁর একটি গরু বাড়ির বারান্দায় রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাশুড়ি ঝগড়া বাধায়। একপর্যায়ে দেবর ও জা তাঁকে ধরে মারধর করেন। আর শাশুড়ি জেলেখা বেগম ফুটন্ত গরম পানি তাঁর মাথায় ঢেলে দেন। পুড়ে যাওয়ায় তাঁর মাথায় ও চোখে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। বাঁ চোখ গরম পানিতে ফুলে গেলেও কিছুটা কমেছে। তবে চোখে তিনি এখন ঝাপসা দেখছেন।
মোখলেছিনা বলেন, ‘স্বামী–সংসারের আশায় কোথাও বিচার সালিস চাইনি। সব সহ্য করেছি। কিন্তু এখন আর নয়। আমি বিচার চাই। আমার মতো আর কোনো মেয়ে স্বামীর সংসার করতে গিয়ে যেন এমন সমস্যায় না পড়েন।’
হাসপাতালের শয্যায় মোখলেছিনার পাশে আছেন মা দেলোয়ারা বেগম। তিনি জানান, লোকমুখে খবর পেয়ে গত সোমবার বিকেলে তিনি জামাতার বাড়িতে গিয়ে দেখেন, তাঁর মেয়ে মোখলেছিনা শরীরের পোড়া যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি করছেন। সেখান থেকে এনে বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওই দিনেই তাঁকে ভর্তি করে দেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। কে আমাদের বিচার করবে? থানা–কোট–কাছারি করলে তো টাকা লাগে। আমার তো টাকা নেই।’
ঘটনার খবর পেয়ে আজ সকালে ঢাকা থেকে ফিরেছেন মোখলেছিনার স্বামী জিয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মায়ের এমন কার্যকলাপ শুনে হতভম্ব হয়েছি। আমি তো কিছু করতে পারব না। আমার স্ত্রী যদি ব্যবস্থা নেয়, বাধা দিব না।’
আজ দুপুরে ঘটনার বিষয়ে জানতে বাড়িতে গিয়ে অভিযুক্ত শাশুড়ি জেলেখা বেগমসহ অন্য দুজনকে পাওয়া যায়নি। এ সময় মোখলেছিনার শ্বশুর ছাদেক আলী বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে তাঁরা ভয়ে বাড়িতে নেই। আমার স্ত্রী জঘন্য কাজ করেছে। বউকে বুঝিয়ে বিষয়টি আমরা বাড়িতে মীমাংসা করে নিব।’
বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ঘটনাস্থল রংপুর কোতোয়ালি থানার অধীনে। ওই ঘটনায় মামলা করলে সেখানেই করতে হবে।