হাদিসুরকে শেষবারের মতো দেখতে বাবা-মায়ের আকুতি

ইউক্রেনে নিহত বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’তে গোলার আঘাতে নিহত নাবিক হাদিসুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনে বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’তে গোলার আঘাতে নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবার–পরিজনের এখন একটাই দাবি, হাদিসুরের (৩২) মরদেহটা যেন তাঁরা দেখতে পান। এ জন্য সরকারের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন তাঁরা।

হাদিসুরের বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে। বাড়িতে উঠতেই দেখা যায় আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কান্না, আহাজারি।

ছেলের মৃত্যুর খবরে অনেকটা নির্বাক বাবা শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন রাজ্জাক। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার আরিফ ‍(হাদিসুরের ডাকনাম) কী ফিরাইয়্যা আইয়্যা বাবা কইয়্যা আর ডাক দেবে না? বাড়ি আইলে কত্তো বড় গলায় দরজা দিয়া ডাক দিত, আব্বা আমি আইছি…। তোমরা ওরে আনো, ওরে তোমরা আনার ব্যবস্থা করো। আমি আব্বা ডাক শুনতে না পারলেও ওরে শেষবারের মতো একবার দেখমু। কইলজাডা আমার শুকাইয়্যা গ্যাছে…আহারে বাবা আমার।’

ছেলের মৃত্যুর খবরে অনেকটা নির্বাক বাবা আবদুর রাজ্জাক

হাদিসুরের বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন অনেকে। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারছিল না। রাজ্জাক বলছিলেন, ‘তোমরা কী কও! আরিফ আমাগো কত্তো খেয়াল রাখতো, ওর মা আর আমার শরীরে ব্যথা পাইলে ও ব্যথা পাইতো। ভাই-বুইন সবাইরে ক্যামনে আগলাইয়্যা রাখতো। এহন কেডা রাখবে?’

এলাকাবাসীর কাছে হাদিসুর ছিলেন শান্ত, নিরহংকারী যুবক। এলাকায় তিনি আরিফ নামেই পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের সবার সঙ্গে মিশতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন।

ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বিলাপ থামছে না মা আমেনা খাতুনের। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে তোমরা এনে দাও। আমার ছেলে গতকাল ভিডিও কল দিয়ে বলেছিল, “মা তুমি যদি বড় বড় লোকমা দিয়ে ভাত খাও, তাহলে আমি বুঝব, তুমি সুস্থ।”’

ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বিলাপ থামছে না মা আমেনা খাতুনের

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী হাদিসুর রহমান ২০০৮ সালে বেতাগী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন বেতাগী সরকারি কলেজে। পারিবারিক আর্থিক টানাপোড়েনে পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটায় ২০১০ সালে ৪.৯৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমিতে। ২০১২ সালে প্রকৌশলী হওয়ার পর চাকরিতে যোগ দেন হাদিসুর।

মেজ ভাই তরিকুল ইসলাম পটুয়াখালী সরকারি কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। ছোট ভাই গোলাম মাওলা ঢাকার কবি নজরুল কলেজের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সবার বড় বোন সানজিদা আক্তার পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত, তাঁর বিয়ে হয়েছে।

নিহত নাবিক হাদিসুরের ছোট ভাই ও বোনের আহাজারি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনার বেতাগী উপজেলার কদমতলা গ্রামে

বোন সানজিদা আক্তার বলেন, ‘পরিবার ও দুই ভাইয়ের পড়াশোনা সব মিলিয়ে আর বিয়ের কথা ভাবেনি। চেয়েছিল দুই ভাইয়ের পড়াশোনা আরেকটু এগিয়ে নিতে। এবার বাড়িতে ফিরলে বিয়ে করাবার জন্য আমরা ভেবে রাখছিলাম। পরিবারের সবাই কনের খোঁজখবর করছিলেন। ওরে কয়েকবার বলছিও, তোমার এবার বিয়ে করতে হবে। বলতো, আর কয়েকটা দিন যাক। কিন্তু বিয়ে তো দূরে থাক, জীবনই থেমে গেল আমার ভাইয়ের…।’

মেজ ভাই তরিকুল বলেন, ‘আমার ভাইকে দেশে আনার ব্যবস্থা করুক সরকার। আমাদের আর কোনো চাওয়া নেই। শেষবারের মতো আমার ভাইকে দেখার সুযোগ দেওয়া হোক আমাদের।’ শোকার্ত আত্মীয়স্বজন, এমনকি গ্রামবাসীরও দাবি, হাদিসুরের মরদেহটা অন্তত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব হবে, এ নিয়ে সংশয় সবার মধ্যে।

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর জলসীমায় গোলা হামলার শিকার বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ থেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে দুটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন নাবিকেরা। এসব নাবিকদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁদের অফলাইনে পাওয়া যায়।

নিহত হাদিসুর রহমানের মামাতো ভাই মো. শাওন আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) পক্ষ থেকে তাঁদের ফোন করে জানানো হয়েছে হাদিসুরের মরদেহ ফ্রিজিং করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জীবিত নাবিকদের এবং নিহত হাদিসুরের মরদেহ দেশের আনার চেষ্টা চলছে। শাওন বলেন, গোলার আঘাতে হাদিসুরের শরীর অনেকটা দগ্ধ হয়েছে।

বিএসসি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সরকারি সংস্থা। এ সংস্থার সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পৌঁছানোর পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সেখানে রয়েছে। জাহাজে বাংলাদেশের ২৯ জন নাবিক রয়েছেন। গতকাল বুধবার জাহাজটিতে গোলার আঘাতে হাদিসুর রহমান নিহত হন। জাহাজটিতে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।