রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে কবিরাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। চিকিৎসার নামে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন অপচিকিৎসা। তাঁদের মিথ্যা কথার ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন গ্রামগঞ্জের সহজ-সরল মানুষ।
ডারারপাড় গ্রামের দিনমজুর মফছার হোসেন (৪৮) বলেন, ‘বাবা, মুই এই কবিরাজের কথা বিশ্বাস করি বিপদে পড়ছিনু। এক মাস আগোত তারাগঞ্জ হাটোত ১০ টাকা দিয়া কবিরাজেরটে পেটের ব্যথার ছয়টা বড়ি কিনছিনু। বড়ি খাওয়ার পর মোর পাতলা পায়খানা ধরছেলো। পরে তারাগঞ্জ হাসপাতালোত ডাক্তার দেখে স্যালাইন ওষুধ খেয়া ভালো হচুন। মোর মতন তোমরা কায় কবিরাজের ওষুধ খান না।’
দোলাপাড়া গ্রামের আরেক দিনমজুর সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা, মোকও কবিরাজ ঠকাইছে। কবিরাজের কথা বিশ্বাস করি দেড় মাস আগোত কোমরের ব্যথার তকনে ওকড়াবাড়ির হাটোত ৯০ টাকা দিয়া মালিশ করা তেল নিছনু। কিন্তু কোনো উপকার পাও নাই।’
হাটে আসা বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব হাটে গানের আসর জমিয়ে বিভিন্ন প্রকার রোগ নিরাময়ের শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে হাতুড়ে কবিরাজেরা ওষুধ বিক্রি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। আসরে হাতুড়ে কবিরাজ বা হেকিম হাজির হয়ে মিথ্যা ও চটকদার কথায় নিজের তৈরি সালসার (ওষুধ) গুনগান শুরু করেন। তাঁরা সালসার বোতল তুলে ধরে পেটের ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, বাত, আমাশয়, মেহ, ডায়াবেটিস, সর্দি-কাশি, অ্যাজমা, যৌনরোগসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগ নিরাময়ের শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ বিক্রি করেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষও খুব সহজে তাঁদের কথায় বিশ্বাস করে ওষুধ কিনছেন।
তারাগঞ্জ হাটের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ২২ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, এক কবিরাজ গানের আসর জমিয়ে বিভিন্ন প্রকার রোগ নিরাময়ের শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ বিক্রি করছেন। তাঁর নাম মফেল উদ্দিন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, তাঁর ওষুধ খেলে সব ধরনের রোগ ভালো হয়। পরে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন।
২৬ মার্চ তারাগঞ্জ হাটের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে তারাগঞ্জ ও/এ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ডমাইকে গান গাইছিলেন মনির নামের এক ব্যক্তি। অর্ধশতাধিক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন সেই গান। একটি গান শেষ করার পর তিনি সমবেত লোকের উদ্দেশে বক্তব্য শুরু করেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে সর্বরোগে কার্যকর স্বপ্নযোগে পাওয়া গাছগাছালি দিয়ে তৈরি ওষুধ বিক্রি করেন তিনি। আসর শেষে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাই, আমি তো কারও কাছোত জোর করি ওষুধ বিক্রি করিছি না। আগের যুগের মানুষ তো গাছগাছালির ওষুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমার ওষুধে মানুষের উপকারে ছাড়া ক্ষতি হয় না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তারাগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ১৫টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হাট তারাগঞ্জ, ইকরচালী, ডাংগীরহাট, বালাবাড়ি, চিকলী ও বুড়িরহাট।
ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন বলেন, হাতুড়ে চিকিৎসক-কবিরাজদের বেশির ভাগই তেমন শিক্ষিত নন। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে অনেকে নিজের নামের পাশে নানা রকম মিথ্যা উপাধি ও ডিগ্রি জুড়ে দিয়েছেন। নানা কৌশলে লোক জড়ো করে সব ধরনের রোগ নিরাময়ের শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এলাকার সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা নিচ্ছেন। এসব চিকিৎসক-কবিরাজের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কোনো অভিযোগও পাইনি। কয়েক দিন আগেই আমি এ থানায় এসেছি। অভিযোগ পেলে এসব কবিরাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোছা. শামছুন্নাহার বলেন, হাটবাজারে গানবাজনা করে আসর জমিয়ে স্বঘোষিত যেসব কবিরাজ ওষুধ বিক্রি করেন, তা অবশ্যই ক্ষতিকর। প্রশাসনের উচিত এসব কবিরাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, শিগগিরই হাটবাজারে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব কবিরাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।