ঘটনাটি দুই বছর আগের। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এক তরুণ নিখোঁজ হন। পরিবারের পক্ষ থেকে ডায়েরি করা হলে শুরু হয় থানা–পুলিশের তদন্ত। গ্রেপ্তার এক রিকশাচালক খুনের স্বীকারোক্তি দিয়ে ২৬ মাস কারাভোগও করেন। পরে পুলিশেরই অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) উদ্ঘাটন করে মূল রহস্য। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে আদতে ওই তরুণ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দাফন হয় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে।
গত ১০ নভেম্বর ইউনুস মিয়া (১৯) নামের ওই রিকশাচালক কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এলে নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। ইউনুস মিরসরাইয়ের দক্ষিণ তালবাড়িয়া এলাকার আবুল খায়েরের ছেলে।
মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছবি দেখে নিখোঁজ তরুণের মা-বাবা শনাক্ত করেন। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা হয়। সেখানেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, এই মামলায় থানা-পুলিশের গ্রেপ্তার আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে শিগগিরই।
ঘটনার শুরু ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই। সেদিন মিরসরাই উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপাহাড় এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এক তরুণ। ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মিরসরাই থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়।
মারা যাওয়া এই তরুণ হলেন রঞ্জন রায়। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। এ দুর্ঘটনার এক বছর আগে মিরসরাই এলাকায় আসেন। কাজ করতেন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে। ওই বছরের (২০১৯) ৭ আগস্ট রঞ্জনের বাবা জ্যোতিষ চন্দ্র রায় বাদী হয়ে মিরসরাই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর ছেলে ১১ দিন ধরে নিখোঁজ। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ। তাঁর সন্দেহ হয় মিরসরাইয়ে একসঙ্গে মেসে থাকা দীপু রায় নামের আরেক যুবক ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করতে পারেন। জিডিটিকে ওই মাসের ২৪ আগস্ট অপহরণ মামলায় রূপান্তর করেন জ্যোতিষ চন্দ্র।
মিরসরাই থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) তাপস চন্দ্র মিত্র মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি নিখোঁজ রঞ্জন রায়ের মুঠোফোনটি ওই এলাকার রিকশাচালক ইউনুস মিয়া ওরফে বাদশার কাছ থেকে উদ্ধার করে ৩১ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। ইউনুস জানিয়েছেন তিনি এটি কিনে নিয়েছেন এক পথচারীর কাছ থেকে। পরে তাঁকে আদালতে হাজির করলে পরদিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে রঞ্জনকে হত্যা করে লাশ খৈয়ারছড়া পাহাড়ে পুঁতে রাখেন বলে জানান। তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন ছিলেন। জবানবন্দি দেওয়ার পর কারাগারে যান ইউনুস। তাঁর জবানবন্দির তথ্যমতে পুলিশ লাশটি উদ্ধার কিংবা জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ইউনুস মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাঁকে মারধর করে। ভয়ে তিনি পুলিশ যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে বাঁচার জন্য সেভাবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রঞ্জনের নিখোঁজ ডায়েরি, সড়ক দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা দুটি তদন্ত করেছিলেন মিরসরাই থানার তৎকালীন এসআই তাপস চন্দ্র মিত্র। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম আদালতে জেলা পুলিশে কর্মরত আছেন। তাপস চন্দ্র মিত্র প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করায় জবানবন্দিও দেন। ভয় কিংবা জোর করা হয়নি স্বীকারোক্তির জন্য।
দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছবি ও নিখোঁজ ডায়েরির ছবি মিলিয়ে দেখলে ১২ দিনের মধ্যে রহস্য উদ্ঘাটিত হতো। সেটি কেন করা হয়নি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই সময় বুঝতে পারিনি। পরে মামলাটি সিআইডিতে চলে যায়।’
গত বছরের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি মিরসরাই থানা থেকে তদন্তের জন্য সিআইডিতে আসে। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ইউনুস মিয়া জবানবন্দিতে আসা ব্যক্তিদের সন্ধান পাননি। রঞ্জন রায় যখন নিখোঁজ হন, তখন মিরসরাই এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয়ের এক তরুণ নিহত হন। তদন্ত কর্মকর্তা দুর্ঘটনায় নিহত তরুণের ছবি সংগ্রহ করেন। রঞ্জন রায়ের মা পার্বতী রানী রায়কে খবর দেওয়া হলে তিনিও চট্টগ্রাম আসেন। দুর্ঘটনায় নিহত তরুণকে তাঁর ছেলে রঞ্জন রায় বলে শনাক্ত করেন। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা দুর্ঘটনায় নিহত তরুণের ডিএনএ সঙ্গে আদালতের নির্দেশে পার্বতী রানী রায়ের ডিএনএ পরীক্ষা করান। এতে দুজনের ডিএনএ ম্যাচ করে।নিহত রঞ্জনের মা পার্বতী রানী রায় বলেন, প্রথমে মনে করেছিলেন খুন। পরে নিশ্চিত হন তাঁর ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
রিকশাচালক ইউনুস মিয়াকে আইনি সহায়তা দেন আইনজীবী উমা দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধে জড়িত না থেকেও পুলিশের ভয়ে স্বীকার করেন। ২৬ মাস বিনা কারণে জেল খাটেন ইউনুস। এ জন্য তাঁরা আইনি পদক্ষেপ নেবেন, যাতে নিরীহ আর কাউকে এভাবে কারাগারে থাকতে না হয়।
তদন্তে গাফিলতি করা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২৬ মাস একজন রিকশাচালকের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কোনো কিছুর বিনিময়ে এটি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।