সুলতান উদ্দিনের বয়স এখন ৫২ বছর। ২২ বছর বয়স থেকেই তিনি আখের গুড়ের ব্যবসা করেন। এই ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁর ভাষ্য, কাপাসিয়ার আখের গুড়ের স্বাদই আলাদা। তিনি বলেন, ‘এই গুড়ের নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে। অন্য গুড়ের মইদ্যে পাইতেন না।’
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জনপদ। এখানকার বেশির ভাগ পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষির একটি বড় অংশজুড়ে আছে আখ চাষ। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এই অঞ্চলে গত বছর ১ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। এখানে পাঁচটি জাতের আখ চাষ হচ্ছে। কাপাসিয়া অঞ্চলের মাটি আখ চাষের জন্য উপযোগী। আখের মিষ্টতা অনেক বেশি। ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২১, ঈশ্বরদী ২/৫৪, টেনাই, অমিত জাতের আখ চাষ হয় এখানে। এর মধ্যে ঈশ্বরদী ১৬ জনপ্রিয়। এখানে বিস্তীর্ণ মাঠে আখ চাষ করতে দেখা যায়। কাপাসিয়ার তরগাঁও, রায়েদ, সিংহশ্রী, বারিষাব, টোক, কড়িহাতা, সনমানিয়া, ঘাগটিয়া, দুর্গাপুর, চাঁদপুরজুড়ে আখ চাষ হয়।
সম্প্রতি পথে যেতে যেতে দেখা হয় সুলতান উদ্দিনের সঙ্গে। কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নে সড়কের পাশে কয়েকজনকে নিয়ে আখ খেতে গুড় তৈরির কাজ করছিলেন তিনি। দুটি বড় কড়াইয়ে আখের রস জ্বাল দেওয়ার কাজ করছিলেন তাঁরা। এসব কাজ দেখভাল করছিলেন আজিজুল হক। পাশে আখের ছোবড়াগুলো রোদে শুকানো হচ্ছিল। আখের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য আখগাছের ছোবড়া ব্যবহৃত হয়।
আখ থেকে গুড় তৈরির বিষয়ে আজিজুল হক বলেন, আখ জ্বাল দেওয়ার পর তা ঘন হয়ে উঠলে টিনের তৈরি ড্রামের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। উত্তাপ কমে এলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুড় জমাট বাঁধে। এ ছাড়া তরল গুড়ের রশিও বাজারে বিক্রি হয়। তরল গুড় বাজারজাতের উদ্দেশ্যে আলাদা বোতলে সংরক্ষণ করা হয়।
কয়েক দশক ধরে সুলতান উদ্দিন উপজেলার বিভিন্ন জায়গার আখ কিনে তা থেকে গুড় তৈরি করেন। এ বছর তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকার আখ কিনেছেন। সেগুলো থেকে উৎপাদিত গুড় যাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে। সুলতান উদ্দিন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানের গুড়ের সঙ্গে কাপাসিয়ার গুড়ের একটা পার্থক্য আছে। এই এলাকার আখ যেমন মিষ্টি, তেমনি মিষ্টি গুড়। ঘ্রাণটাও মিষ্টি।
এসব গুড় পাইকারি ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলে জানালেন সুলতান। তিনি বলেন, অনেকেই গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে মিষ্টতা বাড়ান। কিন্তু কাপাসিয়ার গুড়ে চিনি না মিশালেও চলে। তিনি কখনোই চিনি মেশান না। আখের মান ভালো হলে প্রতি খোলা (গুড় জ্বাল দেওয়ার কড়াই) থেকে ৪০-৫০ কেজির মতো গুড় পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার-পাঁচটি গুড়ের খোলা ওঠানো সম্ভব। তার এসব কাজে সারা বছর অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক সব সময় যুক্ত থাকেন।
এই এলাকায় আখ চাষ হয় বহু বছর ধরে বলে জানালেন রায়েদ গ্রামের বাসিন্দা মানিক মিয়া। বলেন, শুধু গুড় না, চিবিয়ে খেতেও কাপাসিয়ার আখ খুব ভালো। এক একটা আখ আকারভেদে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। একই গ্রামের মো. মোজাম্মেল হক বলেন, কাপাসিয়া এলাকার মাটির একটা বিশেষ গুণ আছে। বিশেষ করে লাল মাটির আখ অনন্য স্বাদের হয়।
কাপাসিয়ায় প্রতিবছর আখ উৎপাদন বাড়ছে। ফলে আখচাষির সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানান কাপাসিয়া উপজেলার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। তবে এ বছর উৎপাদন অনেক বেশি বাড়বে। গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় এই খাতে উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে অনেক কৃষক আখ চাষে নামছেন।