সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুপুরের আলোয় চোখের সামনে ধরা দিল দেশের দীর্ঘতম ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো। বিজয়ের মাসে স্বপ্ন পূরণ হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলাসহ সারা দেশের মানুষের
সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুপুরের আলোয় চোখের সামনে ধরা দিল দেশের দীর্ঘতম ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো। বিজয়ের মাসে স্বপ্ন পূরণ হলো দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলাসহ সারা দেশের মানুষের

পদ্মা সেতু প্রকল্প

স্বপ্নের সেতু রূপ পেল

সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো। যুক্ত হলো পদ্মার দুই পাড়।

প্রমত্তা পদ্মার ওপর দিয়ে একটি সেতু হবে, তার ওপর দিয়ে বাস–ট্রেনে বাড়ি যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমের মানুষ—এ স্বপ্ন বহুদিনের। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গতকাল বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যানটি বসেছে। জোড়া লেগেছে পদ্মার দুই পাড় মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং শরীয়তপুরের জাজিরা। দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো। সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে শুরু হবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল।

পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। তবে স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর থেকেই। মাঝখানে দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত জটিলতায় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে টানাপোড়েনে কিছুটা সংশয়ের মেঘ দেখা দেয়। তখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ হয় ভিন্ন এক মাত্রা, সামনে আসে জাতীয় সক্ষমতার প্রশ্ন। প্রথমবারের মতো বিপুল ব্যয়ে এবং কারিগরিভাবে জটিল এই প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগের মাধ্যমে সেই সক্ষমতার যাত্রা শুরু হয়।

কোটি মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে যোগ হয় সহস্র কর্মীর হাত, শত প্রকৌশলীর মেধা। একেকটা
পিলার (খুঁটি) বসানো, স্প্যান জোড়া দেওয়ার ঘটনা—সবকিছুতেই গর্ব খুঁজতে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। গতকাল ইস্পাতের সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে সক্ষমতার চূড়ান্ত রূপ দেখল দেশবাসী। দুপুরের আলোয় চোখের সামনে ধরা দিল পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো।

উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, শেষ স্প্যান বসানো নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে কিছুটা নিরাপত্তাঝুঁকির তথ্য দেওয়া হয়। সঙ্গে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে শেষ স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তটা উদ্‌যাপনের তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।

কিন্তু উৎসুক মানুষ কি আর বাধা মানে? ট্রলার, স্পিডবোট, লঞ্চ—যে যা পেরেছে, তাই ভাড়া করে ভিড় করে মাঝনদীতে। সেনাবাহিনীর টহল নৌযানগুলো সাইরেন বাজিয়ে এক দিকে সরিয়ে দেওয়ার পরই অন্যদিকে এসে ভিড় করা শুরু করে উৎসুক মানুষ। নৌযানে করে যেসব পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাঁদের অনেককেই নিজের স্মার্টফোন হাতে ছবি তুলে, ভিডিও করে শেষ স্প্যান বসানোর মুহূর্তটি ধরে রাখার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

গতকাল সকালে ট্রলার নিয়ে শেষ স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখতে যাওয়ার পথে মাওয়ার শিমুলিয়া ফেরিঘাটে কথা হয় মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের কাঠ ব্যবসায়ী আমির হোসেনের সঙ্গে। তিনি একা নন, আরও ছয়জন মিলে একটা স্পিডবোট ভাড়া করেছেন দুই হাজার টাকায়। আমির বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে। এখন রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। জমির দাম বেড়েছে। সেতু নির্মাণ শেষ হলে এলাকাটি একটা বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। সব মিলিয়ে উন্নত কোনো এক শহরের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

স্লোগানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ

আগের দিন বিকেলেই শেষ স্প্যানটি নদীর মাঝখানে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে ভাসমান একটি ক্রেনে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক পাহারায় ছিলেন। এরপরও রাতে কোনো কোনো প্রকৌশলী স্পিডবোটে করে স্প্যানটির আশপাশে ঘুরে দেখেছেন। তাঁরা সকালে স্প্যান বসানোর স্থানে জাতীয় পতাকা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সকাল ১০টার দিকে সাইরেন বাজিয়ে স্প্যানবাহী ক্রেনটির কার্যক্রম শুরু হয়। ১০টা ১০ মিনিটে স্প্যানটি পিলারের উচ্চতায় তোলার কাজ শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে পিলারের দিকে। সোয়া ১১টার মধ্যেই স্প্যানটি খুঁটির বরাবর নেওয়া হয়। এরপর কিছু ঝালাই, নাটবল্টুর কাজ আর যন্ত্রপাতির ব্যবহার চলে। ঠিক ১২টা ২ মিনিটে একবারে মাপমতো পিলারে বসে যায় স্প্যানটি। এরপর উপস্থিত প্রকৌশলীরা তাঁদের সঙ্গে আনা জাতীয় পতাকা মেলে ধরে ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

এ সময় মূল সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো প্রকৌশলীর জন্য এমন অভিজ্ঞতা স্বপ্নতুল্য। প্রকল্পের শুরু থেকেই তিনি আছেন। অনেক জটিল, কঠিন মুহূর্ত পার করেছেন। শেষ স্প্যান বসানোর মুহূর্তটি তাঁর পেশাজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

গতকাল শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সেতুর ভারী ও জটিল কাজ সম্পন্ন হলো। প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের স্ল্যাব বসানোর কাজ প্রায় অর্ধেক হয়েছে। এর বাইরে পিচঢালাই, রেললাইন বসানো, সড়ক বিভাজক নির্মাণসহ আরও কিছু কাজ বাকি আছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

মাওয়া থেকে ভাঙ্গা যেভাবে যুক্ত হলো

মূল পদ্মা সেতু বা নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। নদীর দুই তীর থেকে যেখানে মাটি স্পর্শ করেছে, তা ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত। দুই পাড়ের ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৩.৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুটি ৯.৮০ কিলোমিটার। ভায়াডাক্টে যানবাহন ওঠা ও নামার পথ আলাদা।

জাজিরা প্রান্তে সেতুতে ওঠার ভায়াডাক্ট আগেই শেষ হয়ে গেছে। মাওয়ায় ভায়াডাক্টের নামার অংশের কাজ শেষ পর্যায়ে ছিল। ছয়টি গার্ডার (যার ওপর কংক্রিটের ঢালাই ও পিচ দিয়ে পথ তৈরি হয়) লাগানো হলেই মাটি স্পর্শ করে। গত দুই দিনে সেগুলো বসানো হয়েছে। ভায়াডাক্টের মাওয়া অংশের ওঠার আর জাজিরার নামার পথ নির্মাণের কাজ বাকি আছে।

প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভায়াডাক্টের অর্ধেক কাজ বাকি আছে। তবে এখন আক্ষরিক অর্থেই জাজিরা ও মাওয়ার মাটি স্পর্শ করল পদ্মা সেতু।

ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর চীন–বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু পার হলেই পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। ঝাঁ–চকচকে ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে, নান্দনিক সেতু দেখতে দেখতে দ্রুতই পদ্মাপাড় মাওয়ায় যাওয়া যায়। নদী পার হওয়ার পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত একই মনোরম সড়ক। ২০১৬ সাল থেকে নির্মাণ শুরু হওয়া ৫৫ কিলোমিটার এই সড়ক গত মার্চে চালু হয়েছে। ভাঙ্গা থেকে মহাসড়ক কয়েকটি পথে চলে গেছে। চলাচল মসৃণ করতে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দন ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করা হয়েছে, যা প্রকৌশলের ভাষায় ক্লোভার লিফ (এক বোঁটায় একাধিক পাতা) ইন্টারচেঞ্জ বলা হয়।

স্প্যান বাসানোর ইতিবৃত্ত

পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ওই বছর আর কোনো স্প্যান বসানো যায়নি। দ্বিতীয় স্প্যানটি বসে ১১৯ দিন পর। ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই স্প্যানটি বসানো হয়। ওই বছর সব মিলিয়ে মাত্র চারটি স্প্যান বসে।

এরপর আবার লম্বা বিরতি। ২০১৯ সালে এসে স্প্যান বসানোর কাজ গতি পায়। ওই বছর সব মিলিয়ে ১৪টি স্প্যান বসানো হয়। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাইলিংয়ের নকশায় সংশোধন, বন্যা, ভাঙনসহ নানা জটিলতায় কাজ অনেকটাই গতি হারায়। এর ফলে ২০১৮ সালের জুনের পর ২০৮ দিন কোনো স্প্যান বসানো যায়নি।

অবশ্য ২০২০ সালে পদ্মা সেতুর কাজে বেশ গতি ছিল। মাঝখানে বন্যা ও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। জুন মাসের পর ১২২ দিন স্প্যান বসানো বন্ধ ছিল। এরপর টানা ১০টি স্প্যান বসে যায়। সব মিলিয়ে চলতি বছরে ২২টি স্প্যান বসল।

পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর পর

গুরুত্বের কেন্দ্রে পদ্মা

গত নভেম্বরে চারটি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা আগেই নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ৪ ও ১১ নভেম্বর দুটি স্প্যান বসে যায়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১৬ নভেম্বর একটা স্প্যান বসাতে গিয়ে এক হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দেয়। ত্রুটি সারাতে চীনের প্রকৌশলী আনার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির পর থেকে বাংলাদেশে অনঅ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া বন্ধ। বেইজিং থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসও ভিসা দেবে না। এই পরিস্থিতিতে প্রকৌশলীর আসা আটকে যায়, থেমে যায় স্প্যান বসানো।

ঠিকাদার সেতু কর্তৃপক্ষকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরপর এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানেও দিনে দিনেই অনুমতি দেওয়া হয়। ১৬ নভেম্বর রাতেই চীনা প্রকৌশলী লি লিং বাংলাদেশে পৌঁছে যান। পরে ত্রুটি সারানোর কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর চার দিন পর স্প্যান বসানো হয়।

সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এত দ্রুত সরকারি দপ্তরের কাজ হওয়ার ঘটনা খুবই কম। আসলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদ্মা সেতুর বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য দ্রুতই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাচ্ছে।

৪১ নম্বর স্প্যানটি নিয়ে আসা হচ্ছে সংযোগস্থলের দিকে।

আগে যেসব কাজ হয়েছে

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে দুই পাড়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। দুই পাড়ে রয়েছে টোল প্লাজা। এর বাইরে আছে পুলিশ স্টেশন, ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জায়গা।

দুই পাড়ে শতাধিক ডরমেটরি নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে প্রকল্পের কর্মকর্তা, পরামর্শকসহ দায়িত্বরত ব্যক্তিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরে সেগুলো অবকাশযাপন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। রয়েছে বড় মসজিদ, একাধিক অফিস ভবন, ল্যাবরেটরি। এ ছাড়া রয়েছে মোটেল, সংবর্ধনা হল। এর বাইরে আছে পানির ট্যাংক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাহারাদারদের থাকার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। আছে একটি জাদুঘরও।