শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলে কাজ ছেড়ে দিতে। যেহেতু বাচ্চা দুটো ছোট, এর একটা দুধের শিশু। ঝুমু দাশ তাঁদের বোঝালেন, যুদ্ধের মাঠ থেকে সৈনিক পালিয়ে গেলে বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর করোনা মহামারির এই সময়ে মানুষকে সেবা করার সুযোগ পরে আর না-ও মিলতে পারে।
তবু আসন্ন বিপদের কথা ভেবে গাঁইগুঁই করছিলেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। যেহেতু কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ আর এই ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে, তাই ঝুমু দাশ দুই শিশুসন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলেন। পাঁচ বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে ও দুই বছর দুই মাস বয়সী ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন মায়ের বাড়ি। এরপর নেমে পড়লেন কাজে।
ঝুমু দাশ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব)। গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে অন্তত ৮০ জন সন্দেহভাজন করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছেন। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা নিয়েছেন ১২ জনের।
২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন ঝুমু। আড়াই বছরের মাথায় সেখান থেকে বদলি হয়ে আসেন সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গার কাটগড় এলাকায়। স্বামী পুলিশের চাকুরে। ঝুমু এখন থাকছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে।
ঝুমু দাশ প্রথম নমুনা সংগ্রহ করেন ২ মার্চ। সেদিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ঝুমু বলেন, ‘বুকের ভেতর দুরুদুরু কাঁপছিল। এ সময় এগিয়ে আসেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ ওসমানী, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এ টি এম মনজুর মোর্শেদ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) হেলাল উদ্দিন। তাঁদের সহযোগিতা ও সাহসের বলে সেদিন সন্দেহভাজন চার রোগীর নমুনা সংগ্রহ করি।’
তবে বেশি ভয় পেয়েছিলেন ৯ এপ্রিল সকালে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাওয়া এক প্রতিবন্ধী যুবকের বাড়িতে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে। ঝুমু বলেন, ‘তখন আমার ছোট্ট ছেলেমেয়ের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। হাত কাঁপছিল। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মহোদয় পাশে ছিলেন। তিনি সাহস দিলেন। পরে মৃত ওই যুবকের নমুনা সংগ্রহ করলাম।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত মোট ১৬২ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ১৬ জনের। একজন মারা গেছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন ৪ জন। ১১ জন এখনো চিকিৎসাধীন।
>করোনাকালের প্রথম দিকে ঝুমু দাশ একাই নমুনা সংগ্রহ করতেন। একজন নারী হিসেবে একদিকে হাসপাতালে, অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে সমস্যা হচ্ছিল। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত ২১ এপ্রিল আলাদা একটি দল গঠন করে। ওই দলের সদস্যদের নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণও দেন ঝুমু। তাঁরা যে নমুনা সংগ্রহ করে আনেন, তার দেখভালসহ অন্যান্য কাজও ঝুমুকেই করতে হয়।
প্রায় দুই মাস হলো বাচ্চাদের থেকে দূরে আছেন ঝুমু। এর মধ্যে ছোট বাচ্চাটা বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাতকানিয়ার উত্তর কাঞ্চনা গ্রামে মায়ের বাড়িতে ভিডিও কলে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেন, খোঁজখবর নেন। ঝুমু মনে করেন, এই কঠিন সময়ে একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে তিনি দূরে সরে থাকতে পারেন না। তাঁর মতে, করোনা রোগী যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা নেবেন, ততই মঙ্গল।
সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ ওসমানীর কাছ থেকে সব সময় উৎসাহ ও সহযোগিতা পাচ্ছেন ঝুমু দাশ। এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কথায়, ‘প্রথম দিকে সব ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই তাঁকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। একদিন নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে আমরা পাশে থেকে তাঁকে সহযোগিতা করছি। এতে তাঁর মনোবল চাঙা থাকছে।’