সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে অর্ধশত সুপারিশ

কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষা নিয়ে মতবিনিময় সভা। জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষ, কক্সবাজার, ৩০ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে অর্ধশত সম্ভাব্য সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের শতাধিক সমস্যা নির্ধারণ করে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। এসব সমস্যার সমাধান ও উত্তরণে (সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে) রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে মতবিনিময় সভায় আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা সংকট নিরসনে অর্ধশতাধিক সম্ভাব্য খসড়া সুপারিশ উপস্থাপন করেন।

‘সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নিমিত্তে অংশীজনের সাথে মতবিনিময়’ শীর্ষক সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। বক্তব্য দেন সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক, জাফর আলম, কউকের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ, পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান, কউক সচিব আবু জাফর রাশেদ, কক্সবাজার প্রেসক্লাব সভাপতি আবু তাহের প্রমুখ।

কক্সবাজার জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে হলে সেখানে পর্যটক যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিটি ঘরকেই ইকোট্যুরিজমে পরিণত করে সেখানেই পর্যটকদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বলেন, এত সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভ নেই। আপাতত তিন বছর সেন্ট মার্টিনে পর্যটক যাওয়া বন্ধ করা দরকার। যাঁরা সেন্ট মার্টিন নিয়ে বাণিজ্য করেন, কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করছেন, তাঁরা প্রবাল দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেও ভাবেন না।

সভায় সেন্ট মার্টিনের ওপর একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া গেলেও এখন অনেকগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। তিন ধরনের কাছিমের প্রজননস্থান সেন্ট মার্টিন। কিন্তু পরিবেশদূষণে কাছিমগুলো ডিম পাড়তে আসছে না।

সভায় সেন্ট মার্টিনকে রক্ষায় অন্তত ৫১টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় মানুষের জন্য ইকোলজিক্যালি বাসস্থান তৈরির সুযোগ, দ্বীপের বাসিন্দাদের পেশাগত আইডি প্রদান, অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা, দ্বীপের জমি ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ন, হোটেল-রিসোর্টের ধারণক্ষমতা নির্ধারণ, প্রতিদিন কী পরিমাণ পর্যটক দ্বীপ ভ্রমণে যাচ্ছেন, তা নিরূপণ, দ্বীপে নির্মিত সরকারি স্থাপনা বা রেস্টহাউসগুলো শুধু দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার, সাগরে বর্জ্য ফেলা বন্ধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১০০ মিটার অন্তর ডাস্টবিন স্থাপন ও ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দ্বীপে নিস্তব্ধতা ও শান্তি বজায় রাখা, আলো, ফানুস, আতশবাজি ও উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ, সেন্ট মার্টিন সৈকতে ধূমপান নিষিদ্ধ, পাখি, মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও প্রবাল রক্ষায় দ্বীপে স্পিডবোট চলাচল নিষিদ্ধকরণ, শব্দদূষণ রোধে যন্ত্রচালিত মোটরসাইকেল, ভটভটি এবং ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) চলাচল নিষিদ্ধ করে ম্যানুয়াল যানবাহন যেমন রিকশা-ভ্যান ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। পাশাপাশি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পুরোপুরি ঘুরে দেখতে গেলে একজন পর্যটককে এক হাজার টাকা ফি এবং রাতে হোটেলে অবস্থান করতে হলে সরকারি কোষাগারে দুই হাজার টাকা জমা দিতে হবে। সেই টাকা জাহাজের টিকিট বা হোটেলকক্ষ ভাড়ার সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে।

এ ছাড়া দ্বীপ বাঁচাতে পরিবেশ অধিদপ্তর উপকূলীয় বন বিভাগের পরামর্শে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারপাশে অন্তত ১০ হাজার ম্যানগ্রোভ, কেয়াবন সৃষ্টি করবে। পর্যটন ও দ্বীপবাসীর জন্য একটিমাত্র জেটি তৈরি করতে হবে। জেটি নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র দেবে। দ্বীপে বিশেষ সংরক্ষিত অঞ্চল করতে হবে। সব হোটেল-মোটেল দোকান মালিক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব সুয়ারেজ সিস্টেম স্থাপন করবে।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, সম্ভাব্য সুপারিশগুলো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসে, তার বাস্তবায়ন হবে।