নদীর ওপর নির্মিত পুরোনো সেতুটি ভেঙে নির্মাণ করা হবে নতুন সেতু। লোকজন ও যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে সেতুর কাছেই নদীতে বাঁধ দিয়ে বানানো হচ্ছে অস্থায়ী রাস্তা। বাঁধ নির্মাণের জন্য নদীতে কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশ পোঁতা হয়ে গেছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে নদী দিয়ে ভবদহ অঞ্চলে পানিনিষ্কাশন।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়ন ও মনিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের সীমানাঘেঁষে টেকা নদীতে এমন অস্থায়ী রাস্তা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অবশ্য অভিযোগ ওঠার পর বাঁধ ও অস্থায়ী রাস্তা তৈরির কাজ আপাতত বন্ধ আছে। নদীর ওপর নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
মনিরামপুরের এলজিইডি সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় টেকা নদীর ওপর পুরোনো সেতুটি ভেঙে সেই জায়গায় নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ৭ কোটি ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৫০৭ টাকা চুক্তিমূল্যে কাজটি পেয়েছে যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড শামীম চাকলাদার (জেভি)। গত বছরের ১৩ অক্টোবর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, নদীটির পূর্ব পাশে অভয়নগরের বারান্দী গ্রাম এবং পশ্চিম পাশে মনিরামপুরের পাঁচাকড়ি গ্রাম। নদীর ওপরের টেকা সেতুটি জরাজীর্ণ। সেতু থেকে প্রায় ২৫০ ফুট উত্তরে নদীর মধ্যে আড়াআড়িভাবে কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশ পুঁতে দুই স্তরের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশের দুই স্তরের স্থাপনা পেরেক ও লোহার চিকন তার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ ফুট। দুই পাশে ওই স্থাপনা লোহার মোটা তার দিয়ে বাঁধা হয়েছে। মাঝখানে প্রায় ২০ ফুট জায়গা ফাঁকা। সেই ফাঁকা জায়গায় বালু ফেলে ভরাট করে অস্থায়ী রাস্তা নির্মাণ করা হবে। অবশ্য তার আগেই নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
মনিরামপুর উপজেলার পাঁচাকড়ি গ্রামের ভজন বিশ্বাস বলেন, সেতুর কাজ এখনো শুরুই হয়নি। তার আগেই নদীর মধ্যে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধে কচুরিপানা আটকে আছে। নদী দিয়ে পানি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ডুবে মরছে ভবদহের মানুষ।
নদীর মধ্যে স্থাপনা তৈরি করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই মন্তব্য করে মনিরামপুর উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস বলেন, ঠিকাদার বিভ্রান্ত (মিসগাইডেড) হয়ে কাজটি করেছেন। বিষয়টি নজরে আসায় কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, পানিপ্রবাহ সচল রাখতে নদীর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ ফুট জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নদী বন্ধ করার বিষয়টি এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। তাঁরা বর্তমানে কাজটি বন্ধ রেখেছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, ৫ জানুয়ারি ঠিকাদার ৯ জন শ্রমিক দিয়ে নদীর মধ্যে আড়াআড়ি কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশ পুঁতে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করেন। কয়েক দিন পর আরও ছয়জন শ্রমিক তাতে যোগ দেন। বাঁধ দেওয়ায় ১৫ জানুয়ারি থেকে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁরা বাঁধ তৈরির কাজ চালিয়ে যান। বর্তমানে বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ আছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজ (প্রা.) লিমিটেড অ্যান্ড শামীম চাকলাদার (জেভি)-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল নদীর মাঝে শুধু কাঠের গুঁড়িগুলো রেখে বাঁশগুলো তুলে দিয়ে সেই জায়গায় তিনটি বড় আরসিসি পাইপ বসিয়ে দেওয়া। এতে পাইপের ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু তার আগে এলজিইডি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আমাদের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এ জন্য ২৫ জানুয়ারি থেকে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’
মতিয়ার রহমান আরও বলেন, ‘আমরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নদীর ৩০ থেকে ৪০ ফুট জায়গা ফাঁকা করে দেব। এরপর ওই ফাঁকা জায়গায় তক্তা দিয়ে পাটাতন তৈরি করা হবে। পাটাতনের ওপর লোকজন ও যানবাহন চলাচল করবে এবং নিচে দিয়ে পানিপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। এরপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।’
সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করে নদ–নদীর বারোটা বাজানোর নজির যশোরে আরও আছে। যশোর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের ওপর ৫১টি অপরিকল্পিত সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করেছে সরকারের ৬টি দপ্তর। সেতুগুলো ভৈরব নদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে বিঁধছে। সেতুগুলোর দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ ফুটের মধ্যে। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট। নদের দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করে সেতু নির্মাণের ফলে নদের পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ নিয়ে গত বছরের ১৫ জুলাই প্রথম আলোতে ‘নদের টুঁটি চেপে ধরেছে ৫১টি সেতু-কালভার্ট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।