সেতুর দুই প্রান্তে জমির দাম বেড়েছে ১০ গুণ

পদ্মা সেতু থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শরীয়তপুরের আড়াচন্ডি এলাকায় কিনে রাখা জমি
 ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর

পদ্মা সেতুর কাজ যতই এগোচ্ছে, ততই দুই প্রান্তের সড়কের পাশে জমির দাম বাড়ছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এক দশক আগেও ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কের পাশের জমি বেশ কম দামে কেনাবেচা হতো। সেই সময়ের তুলনায় এখন জমির দাম ৮ থেকে ১০ গুণ।

যেমন ২০০৭ ও ২০০৮ সালে পদ্মা সেতুর জন্য যখন জাজিরার চারটি মৌজায় ১ হাজার ৭০১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন সরকার–নির্ধারিত দর (মৌজা রেট) ছিল শতাংশপ্রতি ৭ হাজার ১৫৪ টাকা। বর্তমানে সরকার–নির্ধারিত দর শতাংশপ্রতি সাড়ে ৮৭ হাজার টাকা। অবশ্য জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, জমির বাজারমূল্য আসলে সরকারি দরের দুই থেকে তিন গুণ বেশি।

পদ্মা সেতুতে গত বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানো হয়। এর মাধ্যমে দুই পাশ যুক্ত হয়, পূর্ণতা পায় পদ্মা সেতুর কাঠামো। সরকারের লক্ষ্য ২০২২ সালের পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে গত মার্চে খুলে দেওয়া হয়। জমির দাম বাড়ছে মূলত এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার জন্য জমি কিনছেন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা জমি কিনছেন।

জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার মাসট্রেড নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি গার্মেন্টপল্লি, কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ বিঘা জমি কিনেছেন। তাঁর কেনা জমি জাজিরায় পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। জমিতে এখন বালু ভরাটের কাজ চলছে।

মোবারক আলী সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে। এই জনপদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করবে পদ্মা সেতু। তিনি বলেন, ‘সুযোগটি কাজে লাগাতে আমার মতো অনেক উদ্যোক্তা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি যে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি, তা বাস্তবায়িত হলে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’

পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের উত্তর প্রান্তে নাওডোবা মৌজায় ৩০ বিঘা জমি কিনেছে বাদশা টেক্সটাইল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ জমি কেনাবেচায় যুক্ত ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা বাদল জমাদ্দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাদশা টেক্সটাইল ২০১৫ সাল থেকে পদ্মা সেতু এলাকার আশপাশে জমি কিনতে শুরু করে। প্রথম দিকে প্রতি বিঘা জমির দাম ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ছিল। পাঁচ বছর পর এখন একই এলাকায় জমির দাম বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকায় উঠেছে।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য আড়াচন্ডি এলাকায় জমি কেনা হয়েছে

শুধু শিল্পে বিনিয়োগ নয়, অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল করার জন্যও জমি কিনছেন। জাজিরার বাসিন্দা আনোয়ার ফরাজি ঢাকার ফরাজি হাসপাতালের মালিক। তিনি জাজিরাতে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কিনেছেন।

ঢাকা-শরীয়তপুর সড়কের পাশে আরাচন্ডি এলাকায় জমি কিনে তাতে হাসপাতালের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। সখীপুর হাজি শরীয়তউল্লাহ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল বাসার আল আজাদসহ কয়েকজন চাকরিজীবী মিলে জাজিরার লাউখোলা মৌজায় ১২ বিঘা জমি কিনেছেন। তাঁদের লক্ষ্য শিক্ষাপল্লি প্রতিষ্ঠা করা।

আবুল বাসার আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, জাজিরার অধিকাংশ এলাকা অনুন্নত। শিক্ষার অগ্রগতিও কম। পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে, এমন চিন্তা থেকে জাজিরায় শিক্ষাপল্লি করার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।

শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে জাজিরা উপজেলা সদর হয়ে পদ্মা সেতুতে যেতে হয়। জাজিরার পর থেকেই সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কিনে রাখা জমির সাইনবোর্ড দেখা যাবে। কেউ কেউ জমি কিনে সীমানাপ্রাচীর তৈরি করেছেন। শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে পদ্মার দক্ষিণ প্রান্তে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারকে উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে নজর দিতে হবে।

কেউ বেচতে রাজি নন

পদ্মা সেতুতে যখন অধিগ্রহণ করা হয়, তখন মূল্যের দেড় গুণ ক্ষতিপূরণ পেতেন মালিকেরা। সরকার আইন পাল্টে ক্ষতিপূরণের হার তিন গুণ করেছে। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, নানা প্রকল্পে পদ্মা সেতু এলাকায় আরও জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এমন প্রচারণাও রয়েছে। সেতু এলাকার কাছের জমিগুলোর বিক্রেতা নেই।

পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পড়েছে নাওডোবা ইউনিয়নের মধ্যে। ওই ইউনিয়নের দাদন ফকিরের কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয় ২০০৮ সালে। তখন তিনি যে ক্ষতিপূরণ পান, তা দিয়ে প্রকল্প এলাকার পাশে জমি কেনেন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দাদন ফকিরের নতুন কেনা জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে তিনি আবার পাঁচ বিঘা জমি কিনেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্প, তাঁতপল্লিসহ আরও কিছু প্রকল্পের জন্য অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ এলাকার আরও জমি অধিগ্রহণ করা হতে পারে। তাই এখন আর কেউ জমি বিক্রি করতে রাজি নন।
এপারে আবাসন প্রকল্প বেশি
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে শিল্পে বিনিয়োগের চেয়ে আবাসন প্রকল্প বেশি। জমিতে একের পর এক আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড সেই বার্তাই জানাচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিরাজদিখান উপজেলার জমির দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছিল। তবে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলায় ও এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ায় শ্রীনগর উপজেলার কেসি রোড থেকে দুগাছি এলাকার প্রায় আট কিলোমিটার অংশে জমির দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। আবাসন প্রকল্পগুলো আরও জমি কিনতে আগ্রহী।
স্বপ্নধারা আবাসন কোম্পানির বিক্রয় বিভাগের প্রধান শাহ নেওয়াজ আজাদ বলেন, বছরখানেক আগেও পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। পদ্মা সেতু যত বাস্তবের দিকে যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে তত আস্থা বাড়ছে। এতে জমি বিক্রি দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, করোনার আগে মাসে গড়ে ৫০টির প্লট বিক্রি হতো। চার মাস ধরে প্রতি মাসে গড়ে ৭০টি প্লট বিক্রি হচ্ছে।