১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিলের সকাল। খট খট শব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল। ভেতর থেকে দরজা খুলে দেওয়ার আগেই লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল তারা। বাড়িতেই ছিলেন সুখরঞ্জন। স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কোলে ৯ মাসের এক মেয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে তিন ও পাঁচ বছরের আরও দুই সন্তান। সুখরঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখল সৈন্যরা। যাওয়ার সময় গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল সুখরঞ্জনকে।
চম্পা সমাদ্দারের বয়স তখন প্রায় ২৫ বছর। স্বামী আর ফিরবেন না এমন আশঙ্কা তো ছিলই, যুদ্ধের থমথমে পরিবেশে সন্তানদের নিয়ে কোথায় কার কাছে যাবেন, তা-ও ভেবে পাচ্ছিলেন না। প্রায় আট মাস পর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। নতুন বাংলাদেশে এবার জীবনযুদ্ধে নামতে হলো চম্পা সমাদ্দারকে। কিছুদিনের ব্যবধানে মারা যান বরিশালে থাকা শ্বশুর-শাশুড়ি। চম্পার সম্বল তখন কেবল প্রতি মাসে পাওয়া স্বামীর বেতনের ৯০০ টাকা।
সন্তানদের বড় করতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে নিজেকেও। ১৪ এপ্রিল স্বামীকে হারানো সেই সকাল চম্পার মনে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, ফেলে দিয়েছিল মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে, নতুন করে বাঁচতে এসব থেকেও বের হয়ে আসতে হলো। স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও চম্পা ছিলেন এসএসসি পাস। এরপরও একটা চাকরির আশায় চম্পা গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের কাছে। উপাচার্য বললেন, ‘এই যোগ্যতায় যে চাকরি দেওয়া যায়, সেটি দিয়ে আমি আপনাকে ছোট করতে পারব না। আপনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। পরে আপনাকে চাকরি দেব।’
প্রায় ৪৯ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু ৭৩ বছর বয়সে এসেও উপাচার্যের সেদিনের কথা হুবহু বললেন চম্পা সমাদ্দার। গতকাল শুক্রবার রাজশাহী নগরীর শিরোইল মাস্টারপাড়ায় নিজের বাসায় বসে বললেন, ‘অমন কথা শুনে সেদিন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। এরপরও আবার পড়াশোনা শুরু করি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আবার উপাচার্যের কাছে যাই। উপাচার্য এবার বললেন, “এই পড়াশোনা দিয়েও হবে না। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন।’ ” বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেন চম্পা। স্নাতক শেষ করার পর স্নাতকোত্তরও শেষ করলেন। কিন্তু চাকরির আশ্বাস দেওয়া উপাচার্যের মেয়াদ তখন শেষের পথে।
>শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
চম্পা সমাদ্দারের স্বামী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দার
টিএসসির নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে
চম্পা সমাদ্দার বলছিলেন, ‘সেবার উপাচার্যের কাছে গেলে প্রথমে বলা হলো চারটা প্রথম শ্রেণি না থাকলে শিক্ষক বানানো যাবে না। তবে ভেবেচিন্তে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে বানান রোকেয়া হলের হাউস টিউটর।’
যে বয়সে এসে সাধারণত পড়াশোনা শেষ হয়, তখন থেকেই নতুন করে শুরু করেছিলেন চম্পা। সেই দিনগুলোর স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে অশ্রুসিক্তও হলেন বেশ কয়েকবার। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জানতে পেরেছিলেন, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দিনই হত্যা করা হয় সুখরঞ্জনকে। এখন চম্পা সমাদ্দারের বর্তমান বাড়ির দেয়ালে বড় করে টাঙানো আছে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের ছবি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নামকরণও করা হয়েছে তাঁর নামেই। আর স্বামীকে হারানোর সেই দিন চম্পার কোলে থাকা ৯ মাসের শিশু শিউলি সমাদ্দার এখন স্কুলশিক্ষক। অন্য দুই সন্তানের মধ্যে সবার বড় সলিলরঞ্জন সমাদ্দার চিকিৎসক আর মল্লিকা সমাদ্দার কলেজশিক্ষক। ২০০৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়া চম্পা সমাদ্দারের এখন তাই অফুরন্ত অবসর। শুধু ভাঁজ পড়ে যাওয়া চামড়ায় জীবনযুদ্ধের ক্লান্তির ছাপ।