জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ। তিনি যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘ বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ বাঘ জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ২০১৯-২০ সালে বন বিভাগের অর্থায়নে সুন্দরবনে বাঘের ধারণক্ষমতা–বিষয়ক গবেষণাও তিনি পরিচালনা করেন। মাঝেমধ্যে সুন্দরবনে বাঘের মৃতদেহ পাওয়ার খবর আসছে। সর্বশেষ গত রোববার পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কৈখালী স্টেশনের ধানখালী এলাকা থেকে একটি বাঘিনীর মৃতদেহ উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। সুন্দরবনের বাঘের নানা বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে।
সুন্দরবনে মাঝেমধ্যে বাঘের মৃতদেহ পাওয়ার খবর আসছে। এসব মৃত্যুর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
এম এ আজিজ: বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘ মারা যেতে পারে। যেমন বার্ধক্যের কারণে (দাঁত ভেঙে গেলে শিকার করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন সহজ শিকারের জন্য গ্রামে চলে আসার চেষ্টা করে), নিজের এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে অন্য বাঘের সঙ্গে মারামারি করে আহত হলে, হরিণ শিকারের ফাঁদে আটকে আহত হলে কিংবা বিষটোপের কারণে বাঘ মারা যেতে পারে। শেষের দুটি কারণ সুন্দরবনে ইতিমধ্যে দেখা গিয়েছে।
সুন্দরবনে বাঘের অনুকূল পরিবেশ সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করছেন, এর পেছনে কারণ কী?
এম এ আজিজ: সুন্দরবন একটি অতি সংবেদনশীল প্রতিবেশ। প্রকৃতপক্ষে এটি বাঘের জন্য তেমন উপযুক্ত আবাস নয়। কালক্রমে উত্তরের বনাঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বাঘ নিরুপায় হয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নিয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য বাঘের বসতির তুলনায় সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণী-প্রজাতি বেশ নগণ্য। প্রধান প্রাণী মাত্র দুটি—চিত্রা হরিণ ও বুনো শূকর। তা ছাড়া চিত্রা হরিণের (বাঘ ৭৮ শতাংশ খাদ্য চিত্রা হরিণ থেকে পায়) চোরা শিকার বাঘের জন্য হুমকি। এর সঙ্গে আছে বনাঞ্চলের গুণগত মানের অবক্ষয়। সব মিলিয়ে সুন্দরবনে বাঘ নানামুখী চাপে আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুন্দরবনে বাড়ছে লবণাক্ততা। এ কারণে সংকুচিত হচ্ছে মিঠাপানি আঁধার। এতে বাঘের জীবনচক্র নিয়ে উদ্বেগ আছে?
এম এ আজিজ: সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। গবেষণার অপ্রতুলতা এর প্রধান কারণ। লোনাপানি বাঘের জীবনচক্রের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সেটি আমরা খুব বেশি জানি না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে বাঘের দীর্ঘ মেয়াদে বেঁচে থাকা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। যেমন: ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক চাপ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বনের নানা প্রাণীর জীবনচক্রকেও প্রভাবিত করে, এটি বলা যায়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায়। এ কারণে সুন্দরবনের যে ৭০ শতাংশ ভূমি রয়েছে, তার একটি বড় অংশ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্লাবিত হয়। এতে সুন্দরবনে মিঠাপানির যেসব উৎস (খননকৃত পুকুর) রয়েছে, তা লবণাক্ত হয়ে বন্য প্রাণীর জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। বাঘসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বেশি সমস্যায় পড়ছে।
বাঘের প্রজনন, বেড়ে ওঠা ও টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ সংরক্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
এম এ আজিজ: হরিণের চোরা শিকার বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে বনের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সুন্দরবনে মিঠাপানির জন্য পুকুর সংস্কার ও নতুন পুকুর তৈরি করতে হবে। পুকুরের পাড় উঁচু করতে পারলে দুর্যোগকালে বাঘ ও অন্য প্রাণীরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। এসব নিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি ও উদ্যোগ নিতে হবে।